ছুটির দিনে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। বিশেষত শহরটা যখন কলকাতা! প্রথমে ট্যাক্সিওয়ালা কার্যত লুঠ করল। তার পরে নাকাল হলাম পুলিশের হাতে।
রবিবার দুপুরে সায়েন্স সিটিতে নিয়ে গিয়েছিলাম দুই ছেলেকে। এগারো বছরের ঋষভ আর ন’বছরের রোহন। বেরিয়ে এলাম যখন, তখন সন্ধে নেমে গিয়েছে, ঘড়িতে প্রায় ছ’টা। থাকি বেহালা চৌরাস্তার কাছে বকুলতলায়। বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি ধরব বলে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছু ক্ষণ পরে একটা পেলামও, তবে ট্যাক্সি তারাতলার বেশি যেতে নারাজ।
তা-ই সই। ফেরার তাড়ায় ছেলেদের নিয়ে উঠে বসলাম। ড্রাইভার স্টার্ট করতেই পাশে বসা হেল্পার ছেলেটা বলল, ‘পার্ক সার্কাসের দিকে অবরোধ। রুবি ঘুরে যেতে হবে।’ ওর পরনেও দেখি ট্যাক্সিচালকের পোশাক। দু’জনেরই বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। তখনও বুঝতে পারিনি, ওদের আসল চেহারাটা কী!
বুঝলাম একটু পরে। |
ট্যাক্সি তখন রুবি পেরিয়ে কসবার দিকে ছুটছে। বোসপুকুরের কাছাকাছি এসে আচমকা রাস্তার পাশে গিয়ে ব্রেক কষে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল! চালক বলল, ‘ব্রেকে গোলমাল হচ্ছে। আর যাব না, নেমে যান।’ জায়গাটা আলো-আঁধারি। আশপাশে লোকজনও তেমন নেই। বললাম, দাদা আর একটু এগিয়ে দিন। এখানে তো ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল। কথা কানেই তুলল না ওরা! সায়েন্স সিটি থেকে ওটুকু পৌঁছতেই তখন মিটারে ১২০ টাকা। মানে আমাকে দিতে হবে ২৪২ টাকা। এত টাকার খুচরো ছিল না সঙ্গে। ব্যাগ থেকে পাঁচশোর একটা নোট বার করে হেল্পারের হাতে দিলাম। একটু পরেই সে বলল, ‘আরে, এ তো পঞ্চাশ টাকার নোট!’ শুনে আমি তাজ্জব! ঋষভ তখন বলছে, ‘মা, ও তো সিটের উপর পাঁচশো টাকাটা ফেলে দিল!’ ট্যাক্সির ভিতরে অন্ধকার। আলোটা জ্বালাতে বলায় উত্তর এল, ‘ওটা খারাপ, জ্বলবে না। ভাড়াটা দিন।’
ওদের হাব-ভাব, চোখরাঙানি দেখে ছোট ছেলে তখন ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। ভাল করে দেখে এ বার একটা হাজার টাকার নোট দিলাম। আর এ বার আমার চোখের সামনেই নোটটা সিটের উপরে ফেলে দিল হেল্পার! আর সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা পঞ্চাশের নোট বার করে বলল, ‘চশমা পরেননি নাকি দিদি? বারবার পঞ্চাশ ধরাচ্ছেন!’
আপত্তি করলাম। সব বৃথা। বরং আধো-অন্ধকার রাস্তায় ট্যাক্সির চালক ও তার সঙ্গীর গলায় শুনলাম রীতিমতো শাসানি ‘ঝামেলা বাড়াবেন না। একটা ট্যাক্সি ডেকে দিচ্ছি, চুপচাপ চলে যান।’ আমি একা মহিলা, সঙ্গে দু’টো বাচ্চা। প্রচণ্ড ভয় লাগছিল। ভাবছিলাম, টাকা যায় যাক, ছেলেদের কোনও ক্ষতি করে দেবে না তো? এরই মধ্যে ওরা ‘খারাপ’ গাড়ি হঠাৎ স্টার্ট করে উধাও হয়ে গেল।
তবে আবছা আলোয় ট্যাক্সির নম্বরের কিছুটা দেখে নিয়েছিল আমার বড় ছেলে। তাই ঠিক করলাম, পুলিশে নালিশ করব। এ বার ট্যাক্সি নয়, বাসে চেপে গেলাম গড়িয়াহাট। ওখান থেকে অটোয় তারাতলা। এরই মধ্যে দিল্লিতে কর্মরত আমার স্বামীকে ফোন করে সব জানিয়েছি। উনিও বললেন, পুলিশকে জানাও।
কিন্তু কে জানত, ওখানেও আমার জন্য অপেক্ষা করছে আর এক অভিজ্ঞতা! |
রাত তখন পৌনে আটটা হবে। তারাতলায় কর্তব্যরত ট্র্যাফিক সার্জেন্টকে ঘটনার কিছুটা জানাতে উনি স্থানীয় ‘পুলিশ সহায়তা বুথে’ যেতে বললেন। সেখানে এক পুলিশকর্মী বসেছিলেন। ঘটনাটা ওঁকে সংক্ষেপে জানিয়ে বললাম, লিখিত অভিযোগ করতে চাই। উনি তা নিতেই চাইলেন না! বললেন, ‘যেখানে হয়েছে, সেখানকার থানায় চলে যান। এ ভাবে অভিযোগ নেওয়া যাবে না।’
বারবার অনুরোধেও কাজ হল না। বাধ্য হয়ে বললাম, ‘তা হলে সংবাদ মাধ্যমকে ব্যাপারটা জানাব।’ মিডিয়ার কথা শুনে উনি ট্যাক্সি রিফিউজালের অভিযোগ দাখিলের একটা ফর্ম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এর বেশি কিছু করতে হলে ট্র্যাফিক গার্ডে যেতে হবে। অগত্যা গেলাম বেহালা চৌরাস্তার মোড়ে ট্র্যাফিক গার্ডে। সেখানে মোতায়েন পুলিশকর্মী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ট্যাক্সির নম্বরটা নিয়েছেন তো?’ ঋষভ নম্বরের যেটুকু দেখতে পেয়েছিল (শেষ চারটে অঙ্ক ১৭৪৩), তা ওঁকে জানাল। পুলিশ বলল, পুরো নম্বর বলতে না-পারলে কিছু হবে না। শেষ চারটে ডিজিট ও রকম, এমন অনেক গাড়ি থাকতে পারে। ওখানেও একই রকম একটা ফর্ম দিতে চাইছিল। তা আর নিইনি।
অর্থাৎ, প্রতিকার বলতে কিছু হল না। আপাতত এই অবস্থাতেই রয়েছে পুরো ব্যাপারটা। আমার স্বামী অনির্বাণ ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে পুরো ঘটনা লিখে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের ই-মেলে পাঠিয়েছেন। দেখা যাক, এর পরে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয় কি না!
শুনেছিলাম, শহরের কোথাও কিছু ঘটলে যে কোনও থানায় অভিযোগ লেখানো যায়। পরে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট থানায়। আমার বেলায় কেন তা হল না?
আমাদের শহরটার হঠাৎ কী হল!
|
মহিলাদের সাহায্যে হেল্পলাইন
নিজস্ব সংবাদদাতা |
যখন সরাসরি পুলিশের কাছে এসেও বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে, ঘটনাচক্রে তখনই বিপদে পড়া মহিলাদের সহায়তা করার জন্য লালবাজারে দু’টি টেলিফোন হেল্পলাইন চালু করলেন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎকুমার পচনন্দা। সোমবার তিনি বলেন, “ফোন পেলেই পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে।” কমিশনার জানান, ‘উইমেন ইন ডিসট্রেস’ এবং ‘আস্ক’ নামে এই দু’টি হেল্পলাইন চব্বিশ ঘণ্টা চালু থাকবে। কোনও মহিলা বিপদে পড়লে ১০৯১ নম্বরে টেলিফোন করতে পারেন। অশ্লীল এসএমএস অথবা এমএমএস পাঠানো হলে ওই মহিলা ‘আস্ক’ হেল্পলাইনে সাহায্য পেতে পারেন। সে-ক্ষেত্রে তাঁকে ফোন করতে হবে ৮০১৭-১০০-১০০ নম্বরে। |