রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২
ল্যাজে পা
রম কিন্তু ছিলুম না। এই যে আমি হঠাৎ করে উদার এবং দেদার হয়েছি বড্ড, এই যে আমার ফেসবুকি বান্ধবীদের পিক্স দেওয়ালে উঠলেই ল্যাজে চড়ে বসছি ইদানীং, মামণি আমার যেমনই কাটিং হোক, চলতিফিরতি ফোনক্যামেরার ওয়াইডতম লেন্সে তোলা ডিসটর্টেডতম ছবিতে যতই তাকে কোলাব্যাঙের কর্ণপটহ লাগুক, তার আবক্ষ অসংযম বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে যতই আমি হোঁচট খাই তকতকে তটভূমির হঠাৎ জেগে ওঠা আঁচিল, আর আঁচিল থেকে ফণা তোলা একটা স্পষ্ট গোড়ামোটা লোমে, আমি বেহায়া বঙ্গপুং, ঠায় বসে থাকি জিভ বার করে এক হাত, যদি গলে, যদি গলে, যদি খোলে তার, ভদ্র ভাষায় যারে নাকি বলে মনেরোদুয়ার, শুধু সেই বাসনায়, বিগলিত বুভুক্ষুপনায় এই যে আমি উজাড় করে দিচ্ছি আমার বিশেষণের ল্যাল্যাল্যা, এরম কিন্তু ছিলুম না।
আলটপকা পাবলিকের কথায় গ্যাস খেতুম না আমি। পাবলিকের শালা কালচার নেই, জ্ঞান বুদ্ধি বিদ্যা বালন কিস্যু নেই, পাত্তা দেব কেন? আমি রিভিউ পড়তুম। বড় বড় বিখ্যাতরা কী বলছেন, আরে, কাগজ বলে কথা। মিডিয়া। এলিতেলি যে কাউকে ফট করে লিখতে দেয় নাকি? টিভিতে বলতে দেয়? কত শিক্ষা দীক্ষা ডিগ্রি পাশ অভিজ্ঞতা অধ্যবসায়, কত গম্ভীর গম্ভীর ইংরিজি ইংরিজি সেমিনারে গালে হাত, কত বার্লিনে কত কানে কত দগ্ধ বিদগ্ধ পাঁড় পণ্ডিতের গায়ে গা ঘেঁষে, তবে না আসে অমন আমিআমিজানিজানি গ্লো, তবে না তারা কাগজে লিখতে পারে, তবে না বড়মুখ করে টিভিতে তারা বলতে পারে, এই বইটা আলাদা, এক্কেবারে অন্য রকম, কী?
বইটা দেখেও বুঝলুম, সত্যিই অন্য রকম। কলকাতার কলকলানিতে গেঁজিয়ে ওঠা জীবন, তার মধ্যে রতিশুষ্ক দাম্পত্যে যতিচিহ্ন পড়বে কি পড়বে না ভাবতে ভাবতে, একটু নস্টালজিয়া, আধটু পরকীয়া, আর একটু, বস, একটুখানি স্কচ, এবং রঙের টেক্কা রবীন্দ্রনাথ, ফটাস করে একখানা আউআউআউ গাইয়ে দিয়েছে টিম্বাকটু টোনে, ব্যস, অন্য রকম। এক সময় আর্ট ফিল্ম বলত, তার পর প্যারালাল বলত, এখন অন্য রকম বলে। এরম অন্য রকম বই আগেও দেখেছি আমি, এটা আসলে একটা ক্যাটিগরি। আর, এক বার কায়দা করে এই ক্যাটিগরিতে ফেলে দিতে পারলেই, ছক্কা! মান নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না আর, এ বই বানানোর যে কোন মহান ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল, এ বই দেখার পর কনজিউমার ফোরামে গিয়ে টিকিটের পয়সা ফেরত পাওয়া যায় কি না, যাতায়াত পপকর্ন মাথাব্যথার ওষুধ আর সময়ের দাম কোথায় বিল কাটব, সে সব আর জিজ্ঞেস করা যায় না।
ছবি: দেবজ্যোতি
শুধু হাঁ করে বসে পড়তে কিংবা শুনতে হয়, ঈশ্বরস্পৃষ্ট এক মহতী ক্রিয়েটিভের মানসগর্ভ থেকে হঠাৎ কোন অর্গ্যাজ্মে ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছিল ব্রহ্মময়ী বীজ, কী করে পাতি আড্ডা মারতে মারতে চোখের সামনে স্পষ্টে ছিল সিনের পর সিন, কোন সুরসাগর কী একটা লালালালা শোনাতেই, জিয়ো পাগলা, এইটেই তো চাইছিলুম, আর কেমন যোগাযোগ দ্যাখো, ঠিক ওই সময়েই অমুক অমুক ব্যস্ততমরা ফাঁকাও ছিলেন সব্বাই, চরিত্রগুলো আধ লাইন করে শুনেই বুঝে গেছিলেন, একদম এই পার্টটুকুই করিবার তরে মর্তলোকে আসা। তার পর, কত মজা করে শুটিং হল, আসলে অপেশাদার অব্যবস্থাপনার গুণে গোটা একটা দিন যে ফালতু বসে থাকতে হয়েছিল, সে দিনও কী কী মজা হল, বাব্বাঃ, কী খুঁতখুঁতে ডিরেক্টর, একটা কী যেন শট আটান্ন বার নিল এবং সম্পাদনার কালে দীর্ঘ দার্শনিক মহাবিতর্কের পর সেই শটখানা বাদও পড়ল শেষে, তবে না ভগবান পিচুটি মুখে তেনয়নখানি মেললেন, তবে না তৈরি হল অমন অভূতপূর্ব ইউনিক, তবে না সবাই বলল আমায়, সে কী রে? তুই দেখিসনি? আর তাতেই না আমার গলা অবধি উথলে এল আত্মগ্লানির চোঁয়া, অমনি এত টাকা খচ্চা করে আগ বাড়িয়ে মেজাজ খারাপ করে এলুম। এই যে এত নিষ্ঠা নিয়ে, সমস্ত প্রতিভা আমার ফেসবুকিতায় উগরে দিয়ে, এত দিন ধরে যাকে পটিয়ে পাটপাট করলুম, এই প্রথম বার মিট করতে গেলুম ডিওস্যাঁতস্যাঁতে গায়ে, অন্য রকম বই দেখাতে নিয়ে গেলুম আহ্লাদ করে, এই যে সে খচে লাট্টু হল আমার ওপর, আরও থাকলে আরও বোর হবে বলে ভয়ের চোটে পালিয়ে গেল বাড়ি, এবং আড়ি, এই যে আমি তাকে বোঝাতে পারলুম না, আমি অমনটা নই, আসলে আমি গোবিন্দাকে সবচেয়ে ভালবাসি, কিন্তু গোবিন্দার বই দারুণ বললে জাত থাকবে কি না ভাবতে ভাবতে, কী বলুন তো, শুধু ফুর্তির জন্য কিছু করা যায় না, তার একটা মানে থাকতে হয়, একটা ভাবনা থাকতে হয়, মস্তিবাজির মোড়কে আসলে রাখতেই হয় বিপ্লবী এক বোমা, নইলে বমি, নইলে কী যেন একটা কী, যাতে টিকিটের সঙ্গে মানেবইটা বিনামূল্যে বিতরণ বাধ্যতামূলক। কী?
এই যে ডেলি এখানে সেখানে আন্ডা উব্লাচ্ছে আর ডাইনোসরে বেজন্মাচ্ছে, যা লেখা হচ্ছে, যেখানে যা আঁকা হচ্ছে, নাটক গান কাব্য গল্প সব, সব অসাধারণ, তিনশো ষাটখানা দ্রাঘিমারেখা পাক খেয়ে এলেও অমনটি আর নাই। আগে তাও এর প্রভাব তার প্রেরণা বলে জিভ কাটত, এখন সাউথের বই যে টুকছে, শুধু সে ছাড়া, বাকি সব সেয়ানা যেন আপন বীর্ষগুণে থানকা থানকা হিরে ফোটাচ্ছে রোজ, সবাই সবাইকে মৌলিক বলছে, মিহি বলছে, মাখন বলছে। এমনকী নিজেও নিজেকে বলছে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিনয়ে অভিনয়ে নেকিয়ে-বেঁকিয়ে বলছে, কিন্তু বলছে। মিনিমাম আত্মসম্মান থাকলে যা কোনও মানুষের বাচ্চা কোনও দিন করতে পারবে না, বেহায়ার মতো নিজের কৃষ্টিকর্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছে নিজের মুখে। আসলে কিছু করার নেই, কী এক গুপ্ত গহন গূঢ় তত্ত্ব ফলাতে গিয়ে, সোনামুখ করে যা প্রসব করেছে, তা যে বাথরুমে হ্যারিকেন ধরারও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি, বোকা বদমাশ নিজে তো সেটা জানে। এখন চালাকি করে চন্দন পরিয়ে তাকে স্বপ্নে পাওয়া শিবলিঙ্গ ঘোষণা করতে না পারলে, লোকে যদি ফালতু পাথর বলে লাত্থি মারে, সেই ভয়ে বলছে। বলতে বলতে একটা সময়ে নিজেরাও বিশ্বাস করতে শুরু করছে, আপ্লুত হয়ে পড়ছে, নাল গড়িয়ে খাল করে, গোলানো গাঙে ভাসতে ভাসতে, গু খেতে খেতে, ভাবছে বুঝি পৌঁছে যাবে গঙ্গাসাগর! গোটা একটা জাত!
আর, উৎকর্ষের এই উদ্বাহু উৎসবের মধ্যে ধাঁধিয়ে গিয়ে, এই যে আমিও বলতে পারছি না, সবাই যদি সব কিছু নিয়ে এত খুশি হতে শিখে যায়, তা হলে ভুসি ছাড়া আর যে কিছুই সৃষ্টি হয় না ভুবনে। উল্টে এই যে আমিও ঘেঁটে যাচ্ছি, সিঁটিয়ে যাচ্ছি হাড়হিম হীনম্মন্যতায়, তা হলে কি নাম জানা কোনও নাটকের দল একটা নাটকও খারাপ করছে না? মোটামুটিও করছে না? সব দারুণ দারুণ করছে? যত গান বাজছে অটোয়, সবই কি তা হলে সোনাটা? সকলেই তবে কবি? মন্দ বলে, মাঝারি বলে কিছুই কি তবে হচ্ছে না এই বঙ্গে? এই এত ভাল, এত এত এত ভাল, সবাই যখন দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, তা হলে কি আমারই শুধু খামতি হয়েছে কোনও? স্বাদগ্রন্থি টকে গেছে? নইলে, এই যে আমিও ওই গড্ডলিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আতঙ্কে, চোখ কচলে কচলে ভাল খোঁজার চেষ্টা করছি অনর্গল, এরম কিন্তু ছিলুম না।
এখন এই আধ-দামড়া বয়সে, কোমরের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার পর, নোলা তো আর যায়নি, তাই ফেসবুকে কাকে কী লিখছি, সেটা অন্য কথা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.