বাবা-মা’র সঙ্গে এই প্রথম কলকাতার দোকানে পুজোর জামা কিনতে আসা। কী বড় দোকানটা! বাবা বলেছে এগুলোকে বলে মল। মল মানে আর একটা জিনিসও হয়... হি হি। আগের কাকুটা বেরনোর পরেই দুটো প্যান্ট আর একটা শার্ট হাতে বিল্টু ঢুকল। মা-বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মা বার বার বলে দিয়েছে, ভাল করে দেখে নিবি। টাইট হলে বলবি। ঢিলে হলেও।
ভেতরে ঢুকে ছিটকিনি বন্ধ করতেই হেব্বি মজা লাগল বিল্টুর। তিন দিকে অ্যাত্ত বড় বড় আয়না। বিল্টু যতটা লম্বা, ঠিক ততটাই আয়নায় দেখাচ্ছে। দারুণ তো! বাড়িতে মা-বাবার ঘরের আয়নাটা এত বড় নয়। বাথরুমের আয়নাটাতে তো শুধু নিজের মুখটুকু দেখতে পায় ও। তা-ও পা উঁচু করে। বাবা বলে দিয়েছে, একদম দেরি না করতে। নিজের গোল গলার লাল গেঞ্জিটা ছাড়ার আগে এক বার আয়নার দিকে দাঁত খিঁচোলো বিল্টু। জিভ বার করল অনেকটা। এক বার ঘুষি দেখাল। আয়নাটাও ঠিক তেমনই দেখাল ওকে। বিল্টু গেঞ্জি ছাড়ল। আবার তাকাল। পাটকাঠি হাত, হারমোনিয়ামের রিডওয়ালা বুক। কিছুতেই অক্ষয়কুমারের মতো বডি হচ্ছে না। কবে যে বড় হবে! তাও এক বার দু’হাত মুঠো করে তুলে মাসল ফোলানোর ভঙ্গি করল। ধ্যাৎ, ভাল্লাগে না। একটুও ‘মার্সেল’ ফোলে না। মন খারাপ করে নিজের হাফপ্যান্টটাও ছেড়ে ফেলল। আয়নার দিকে তাকাতেই ... এ বাবা, একেবারে ন্যাংটোপুটু! বাড়িতে বিল্টু গামছা পরে চান করতে যায়। দরজা বন্ধ করে প্যান্ট ছাড়ে। এক দিন ওর বন্ধু বুকাই ওদের রান্নাঘরের পিছনে ফিসফিস করে বলেছিল, এই তোরটা দেখি। এই দ্যাখ আমারটা। ইশ্শ্, খুব লজ্জা লাগছিল বিল্টুর। ভয়ে শীত শীত করছিল। আবার দেখতেও ইচ্ছে করছিল খুব। মা ডেকেছিল তক্ষুণি। অমনি দৌড় লাগিয়েছিল ও। বুকাই জোরে বলেছিল, কাউকে বলিস না যেন। কাউকেই বলেনি ও।
আয়নায় নিজের ন্যাংটোপুটু দেখতে নেই। কিন্তু কেমন একটা লাগছে! শীত করছে। কাঁটা লাগছে গায়ে। মা বলেছে, খালি গায়ে বেশি আয়না দেখলে অসুখ করে। দেখব না ভেবে পিছন ফিরে গেল ও। সেখানেও আয়না। ধুৎ! এ বার আয়নার খুব কাছে এগিয়ে এল বিল্টু। একদম কাছে। আয়নায় নাক ঠেকাল। |
স্বামীর নাম শিবু প্রামাণিক। জন্ম, শিক্ষা, বিবাহ সবই আরামবাগ মহকুমার মধ্যে। বহু কালের শখ ছিল কলকাতার বড় দোকান থেকে পুজোর কেনাকাটা করার। পয়সার অভাবে অ্যাদ্দিন হয়নি। এখন ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। স্বামীর ব্যবসা, বলতে নেই, বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। তাই এ বছর ও-ই নিজে থেকে নিয়ে এসে দারুণ একটা সালোয়ার কিনে দিল। ডিপ নীল রং। তার মধ্যে রুপোলি জরির কাজ। দারুণ দেখতে, কিন্তু বড্ড দাম। তাপসীর লোভ হয়েছিল প্রথমেই, কিন্তু বলতে সাহস হচ্ছিল না। যদি এত লোকের সামনেই খিঁচিয়ে দেয়। কিন্তু শিবু ঠিক বুঝতে পেরে ওটা হাতে দিয়ে বলল, যাও এক বার পরে দেখে নাও ঠিকঠাক মাপে হচ্ছে কি না।
খুপরি ঘরটায় ঢুকল তাপসী। নড়তে চড়তে গা ঠেকে যায়, তাতে আবার তিনটে আয়না। শাড়ির আঁচলে হাত দিতে গিয়েও আবার হাত নামিয়ে নিল। বাইরে এত লোক। সবার গলা শোনা যাচ্ছে। যদি দুম করে ছিটকিনিটা খুলে যায়! ওটা আর এক বার দেখে নিয়ে আবার শাড়ির আঁচলে হাত। হলুদ রঙের শাড়ি ছেড়ে হুকে ঝোলাল। সাদা সায়া আর হলুদ ব্লাউজ। কেমন গা শিরশির করছে। আয়নাগুলো এত কাছে যে নিজের ছায়াই যেন গায়ের ওপর এসে পড়ছে । ঘরটা এট্টু বড় করতে পারল না এরা। এত বড় দোকান দিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই তাপসী আড় চোখে নিজের পেছনটা দেখে নিল। সাধে কি দশ বছরের একটা ছেলে থাকা সত্ত্বেও পাড়ার লোকগুলো এখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে! আর পাশের বাড়ির মুখার্জিদার ছেলেটা, এ বার হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, সে-ও ঘুরঘুর করে তাকায়! ওরে আমি তোর কাকিমা হই। মুখার্জিদার বউয়ের এই বয়সেই যা অবস্থা। পেট দেখে মনে হয় সাত মাসের পোয়াতি। নিজেকে আর একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ও। এত বড় তিন-চারটে আয়না কেনার তো আর সাধ্য হবে না কোনও দিন। আর হলেও, এ সব তো আর বাড়িতে লাগানো যায় না। নাকের ডগায় ঘাম জমে উঠছিল অনেক দিন পর। হঠাৎ চোখ দুটো একেবারে সেঁটে গেল হলুদ ব্লাউজের ভেতর ঠেসে থাকা বুক দুটোর ওপর। ওরা কি এখনও সেই আগের মতোই আছে? আগের মতো? বিয়ের পর পরই ঠিক যেমনটা হয়ে উঠেছিল? ভাল করে দেখা হয় না কত দিন। বাথরুমেও না। ছোট আয়না। লজ্জাও করে খুব। শুকনো মরা চামড়ার মতো ব্লাউজটাকে খুঁটে ছাড়াল গা থেকে। হলদেটে হয়ে যাওয়া সাদা ব্রা খুলেই সিঁটিয়ে গেল। অনেক দিন ইট চাপা পড়া ঘাসের মতন, শ্যামলা শরীরের ভেতর ঈষৎ ফরসা বুক দুটো জেগে আছে। বোধহয় অনেক লজ্জা বিরক্তি আর অপমানেই, তাদের মুখগুলোও গুটিয়ে গিয়েছে, তাপসীর মতোই। তার পরেই শক লাগল। কে যেন বলেছিল, এই সব ট্রায়াল রুমে নাকি ক্যামেরা লুকনো থাকে!
আয়নাগুলোর পেছনেই ক্যামেরা নেই তো? এই মুহূর্তে দোকানের কয়েকটা লোক কি তা হলে তারিয়ে তারিয়ে...? ওরা কি ওই ছবিগুলো কম্পিউটারে তুলে দেবে! ছি ছি এ কথা আগে মনে এল না পোড়ারমুখি! হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ব্রা-ব্লাউজ খামচে তুলে পরতে গিয়ে জট পাকিয়ে গেল সব। ব্লাউজের হুকে ব্রা আটকে গিয়েছে বিচ্ছিরি ভাবে। কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না।
|
এক কালে প্রগতিশীল পার্টির হোলটাইমার ছিল। বর্তমানে ছোটখাটো প্রোমোটার। সেই আরামবাগ থেকে ইন্ডিকা ভাড়া নিয়ে বউ বাচ্চা সমেত মল-এ মার্কেটিং করতে এসেছে। ঝাড়া সাতচল্লিশ মিনিট কোলে সন্তানের মতো তিনটে জিন্সের প্যান্ট আর দু’টো টি-শার্ট ঝুলিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিল। পা টনটন করছে। শালারা একটু বসার জায়গা করেনি কোথাও। প্যান্টের চেনে হাত দিল শিবু। দেওয়ালের তিনটে আয়নার প্রতিবিম্ব ওর দেখাদেখি নিজেদের প্যান্ট খুলল একই স্টাইলে। তার পর পাঞ্জাবি ছেড়ে দরজার হুকে ঝুলিয়ে আয়নায় চোখ ফেলতেই খানিকটা চমকে উঠল। তিন দেওয়ালে তিনটে লোক ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। মাথার পেছনে গোল বাটির মতো টাক। খয়েরি জাঙিয়ার দু’দিক দিয়ে বেরোনো দু’টো কালো লিকলিকে লোমশ ঠ্যাং। পিঠে জাঙিয়ার ঠিক ওপরে এক থাবা বিশ্রী লোম। হঠাৎ ফুলে ওঠা লদলদে একটা ভুঁড়ি। শিম্পাঞ্জির মতো উঁচু পাছা। কোমরে বুলেট বেল্টের মতো কালো কার-এ বাঁধা সারি সারি শেকড়। ঘোলাটে চোখের নীচে অ্যালকোহলের কোলবালিশ। দরজায় টোকা পড়ল বাইরে থেকে, ‘দাদা, তাড়াতাড়ি।’
চমকে উঠে শিবু তাড়াতাড়ি একটা প্যান্ট হাতে নিয়ে পা গলাতে গিয়ে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মিনিট খানেক এক পায়ে নাচল, তার পর দুম করে পড়ে গেল মেঝেতে। ওইটুকু খোপে চিৎপাত হয়ে পড়া যায় না, তাই দলা মোচড়া পাকিয়ে পড়ল। আয়নায় নিজের ঘষটানো মুখ। তিনটে হাফ-উদোম ওরই মতো গুটলি পাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে শিবুর দিকে তাকিয়ে আছে। শিবু না উঠতে পারলে ওরাও কেউ উঠতে পারবে না। অনেক কষ্টে দেওয়াল ধরে শিবু উঠল। আর ট্রায়ালে কাজ নেই। দেওয়ালের তিনটে লোককে জাস্ট সহ্য করা যাচ্ছে না। এত কুৎসিত! নিজের বাড়ির আয়নায় এতটা দেখা যায় না তো। কোনও মতে শিবু নিজের পুরনো পাঞ্জাবি আর জিন্স গলিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসার আগে আর এক বার আয়নায় চোখ রাখতেই, এ কী! আয়নার শিবুগুলো সব উদোম হয়েই দাঁড়িয়ে আছে! |