পুরুলিয়া জেলার অপরাধ-মানচিত্রে বরাবর আদ্রা উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে। জঙ্গলমহলে অশান্তির সময়েও অপরাধমূলক কাজের নিরিখে আদ্রার গুরুত্ব কমেনি। তবুও অপরাধ-প্রবণ এই এলাকায় কেন পৃথক ভাবে একটি থানা তৈরি করা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আম জনতার মনে, পুলিশ মহলেও।
রেলের বিভাগীয় সদর শহর আদ্রায় অপরাধ লেগেই রয়েছে। তা নিয়ে পুলিশ আধিকারিক ও কর্মীরা যথেষ্ট বিব্রত হলেও তদন্তকারী কেন্দ্র হিসেবেই রয়ে গিয়েছে আদ্রা। আদ্রা রেল জংশন দিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকার দূরপাল্লার বহু ট্রেন ছুটছে। বিভিন্ন ভাষাভাষির বহু মানুষ প্রতিদিন এই স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করছেন। এই রেল শহরের অনেকখানি এলাকা জুড়ে রয়েছে রেলের কর্মী আবাসন। রয়েছে রেলের অনেক অফিসও। ঝাড়খণ্ডের সীমানাও বেশি দূরে নয়। এই রেল শহরের সঙ্গে বেকো ও গগনাবাইদ পঞ্চায়েত জুড়ে প্রায় ৪৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে চলছে আদ্রা তদন্তকারী কেন্দ্র। জনসংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৩৮ হাজার। রয়েছে ৭টি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ও তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। রেল ও এনটিপিসি’র যৌথ উদ্যোগে এই এলাকাতেই তৈরি হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর এসবের নিরাপত্তার জন্য আদ্রা তদন্ত কেন্দ্রে রয়েছেন দু’জন সাব-ইনস্পেক্টর (এসআই), ৪ জন এএসআই ও ১৪ জন কনস্টেবল। তদন্ত কেন্দ্রে রয়েছে দু’টি পুরনো গাড়ি। পুলিশ কর্মীরাই জানিয়েছেন, একটি গাড়ি কার্যত বিকল। অন্যটির অবস্থা তথৈবচ। চোরের পিছু ধাওয়া করতে ভরসা কয়েকটি মোটরবাইক! আদ্রায় কাজ করে যাওয়া এক পুলিশ আধিকারিকের প্রশ্ন, “আদ্রার মতো এলাকায় এই মান্ধাতার আমলের পরিকাঠামো নিয়ে দুষ্কৃতীদের দমন করা সম্ভব কি?” |
এ যেন আদ্রাবাসীর মনের কথা। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা দাবি করছেন, আদ্রায় এ বার স্বয়ংসম্পূর্ণ থানা ঘোষণা করা হোক। সাধারণ আর পাঁচটা থানা এলাকায় যে সব অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে, এখানেও তেমন ঘটনার কোনও দিনই ভাটা পড়েনি। তার উপর রেলের ঠিকা সংক্রান্ত গোলমাল পুলিশ প্রশাসনের বড় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। রেলের কাজের বরাত পাওয়া নিয়েও এই এলাকায় কম খুনোখুনি হয়নি। গত কয়েক বছরেই আদ্রায় রেলের ঠিকাদারি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। দুষ্কৃতীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যে খোদ ডিআরএমের অফিসের কাছে প্রকাশ্য দিবালোকেও তারা বন্দুক চালিয়ে গুলি করতে পিছপা হচ্ছে না। আরও কয়েক বছরের হিসেব জুড়লে এই ধরনের খুনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৯। পুলিশ সূত্রের খবর, জেলায় ‘ক্রাইম রেটে’ জঙ্গলমহলের কয়েক বছরের ঘটনাগুলি বাদ দিলে আদ্রা বরাবরই প্রথম সারিতে। তা ছাড়া, যে থানার আওতায় রয়েছে আদ্রা তদন্তকেন্দ্র, সেই কাশীপুর থানায় মাসে যতগুলি অভিযোগ নথিবদ্ধ হয় তার মধ্যে ৬০ শতাংশই আদ্রার।
জেলা পুলিশের একাধিক আধিকারিকও স্বীকার করেছেন, “কিছু তথ্য আর পরিসংখ্যান দিয়ে আদ্রার অপরাধের চরিত্র বোঝা যাবে না। নানা কারণে এলাকার অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।” জেলার পুলিশ মহলে একটা কথা চালু রয়েছে-- আদ্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেই রঘুনাথপুর মহকুমা থেকে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।” কারণ, অনেকাংশে এই এলাকার অপরাধীদের চালনা করেন ঝাড়খণ্ডের অপরাধীরা। যারা রেলের ঠিকাদারি ব্যবসা নিজেদের কুক্ষিগত করার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আদ্রায় তাদের ঠেকাতে পারলে এলাকার দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত কমবে। জেলার অন্যান্য এলাকাতেও তাদের প্রভাব ও দৌরাত্ম্য কমবে। তাই আদ্রার ঠিকাদার থেকে ব্যবসায়ী, রেলের আবাসিক থেকে সাধারণ বাসিন্দা সকলেই এখন আতঙ্কে রয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনও তা বোঝে। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে আদ্রা তদন্তকারী কেন্দ্র থেকে এর বেশি কিছু করাও সম্ভব নয় বলে তাঁরা জানাচ্ছেন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও আদ্রায় থানা না থাকার সমস্যায় রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। কাশীপুর থানার আওতায় আদ্রা তদন্তকেন্দ্র থাকায় মামলা সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্রের কাজ করতে হয় কাশীপুরের মাধ্যমে। আদ্রায় শুধুমাত্র অভিযোগ গ্রহন ও তদন্ত করার অনুমতি রয়েছে। পুলিশ কর্মীরা জানিয়েছেন, আদ্রায় কোনও অভিযোগ করা হলে তার কেস নম্বর নিতে হয় কাশীপুর থানা থেকে। আদ্রা এলাকার কোনও অভিযুক্তের নামে ওয়ারেন্ট বের হলে আদালত থেকে তা কাশীপুর থানায় জানানো হয়। সেখান থেকে ওয়ারেনেট জানানো হয় আদ্রাকে। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অপরাধীকে আদ্রা তদন্তে কেন্দ্রের পুলিশি হেফাজতে নিতে হলেও বহু ঘুরপথে জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে আবেদন করতে হয়। আদ্রা থেকে কাশীপুর থানার দূরত্ব কমবেশি ৮ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিনই নানা কাজে আদ্রার পুলিশ কর্মীদের কাশীপুরে যাতায়াত করতে হয়। এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “আর এইসব সমস্যাগুলির জন্যই তদন্তের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এলাকায় যে সব খুন হয়েছে, তার অনেকগুলির এখনও কিনারা করা যায়নি। জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তাও স্বীকার করেন, “তদন্তকেন্দ্রের সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে বড় মাপের অপরাধের কিনারা কার্যত অসম্ভব। থানা হলে আদ্রার পরিকাঠামো একধাপে দ্বিগুণ হয়ে যেত। অপরাধ দমনে পরিকল্পিত ভাবে কাজ করতে পারত আদ্রার পুলিশ।” পুলিশ সূত্রের খবর, আদ্রায় থানা তৈরির প্রস্তাব রাজ্যের বিগত বামফ্রন্ট সরকারের কাছেও জেলা থেকে স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠানো হয়েছিল। তৃণমূলের আদ্রা শহর কমিটির সভাপতি ধনঞ্জয় চৌবে বলেন, “আগের বাম সরকার আদ্রাকে থানার স্বীকৃতি দেয়নি। আমরা দলগত ভাবে বিধায়কের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের কাছে ওই দাবি জানিয়েছি।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য প্রদীপ রায় বলেন, “আদ্রায় থানা তৈরির জন্য আমারও দলের তরফে জানিয়েছিলাম। এখনকার রাজ্য সরকার তো কতগুলি কমিশনারেট ঘোষণা করেছেন, মহিলা থানা চালু করছেন। আদ্রার বিষয়টি ভাবছে না কেন?” কাশীপুরের বিধায়ক তৃণমূলের স্বপন বেলথরিয়া বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আদ্রাকে থানা হিসাবে গড়ে তোলার আর্জি জানিয়েছে। তাঁর আশ্বাসও পেয়েছি। আশা করছি দ্রুত আমাদের দাবি পূরণ হবে।” পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “আদ্রাকে থানা হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাজ্য সরকারের কাছে আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি।” |