ব্যাগ গুছিয়ে...
হাত বাড়িয়ে কুঁয়ারি পাস
দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই দলপতির ডাকে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। বাইরে তখন আমাদের পথপ্রদর্শক তাঁর দলবল নিয়ে হাজির। সঙ্গে যোশীমঠ থেকে আউলি যাওয়ার গাড়িও। যোশীমঠ থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম আউলি। আউলি থেকেই আমাদের হাঁটা শুরু হবে কুঁয়ারি পাস-এর (১৩,৯৯৩ ফুট) উদ্দেশে। যোশীমঠ থেকে শুরু করে মাত্র পাঁচ দিনের হাঁটাপথে কুঁয়ারি পাস অতিক্রম করে আবার যোশীমঠ পৌঁছে যাওয়া যায়। হাঁটা শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম আউলি টপ-এ। এখান থেকেই এই যাত্রায় প্রথম দেখতে পাওয়া যায় হাতি-ঘোড়া, দ্রোণাগিরি-সহ নামী-অনামী পর্বতচূড়ার সারি। সাধারণ পর্যটকেরা রোপওয়েতে যোশীমঠ থেকে আউলি টপ পর্যন্ত যেতে পারেন।
প্রথম দিন আউলি থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে গারসন টপ-এ পৌঁছে রাত্রিবাস করতে হবে। প্রথম দিন চলার গতি কম হওয়ায় বাঁ দিকে হাতি-ঘোড়া আর দ্রোণাগিরিকে সঙ্গী করে আউলি টপ, গারসন বুগিয়াল অতিক্রম করার পরে সূর্যাস্তের রং সঙ্গে নিয়ে আমরা হাজির হলাম গারসন টপ-এ। আজ এখানেই হবে রাত্রিবাস। তাঁবু খাটিয়ে রাতের আহারের ব্যবস্থা করতে হল দিনের আলো থাকতেই। এখান থেকেই প্রথম দেখা মিলল পর্বতশৃঙ্গ নন্দাদেবীর। সূর্যাস্তের সোনালি রঙে রাঙানো নন্দাদেবী ও তার ডান-দিকে বাঁ-দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে হাতি-ঘোড়া, দ্রোণাগিরি ও ত্রিশূল-সহ বেশ কিছু নামী-অনামী পর্বতশৃঙ্গ। এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে করতে দিনের শেষ আলোয় রাতের খাওয়া শেষ করে সন্ধ্যা নামা মাত্রই চলে গেলাম তাঁবুর ভিতর। তাঁবুর বাইরের তাপমাত্রা যে হিমাঙ্কের আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে, তাঁবুর ভিতর থেকেই তা টের পাওয়া গেল!
পর দিন তাঁবুর ভিতর থেকে দিনের প্রথম আলোয় নন্দাদেবীকে দেখতে দেখতে আমাদের অভিযানের দ্বিতীয় দিনের সূচনা করলাম। আজ আমাদের প্রায় ১৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে চিত্রখানায়। এই পথের বেশির ভাগ রাস্তাই পাড়ি দিতে হয় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। জন্তু-জানোয়ারের ভয় না থাকলেও পথ হারানোর আশঙ্কা যথেষ্টই। বছরে চার থেকে পাঁচ বার যাতায়াত করা গাইডকেও বিধ্বস্ত হতে দেখেছিলাম। কিছুটা পথ এগনো, আবার আমাদের বসিয়ে রেখে পথ ঠিক করতে করতে অতি সতর্কতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলল গাইড। প্রায় দশ কিমি রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছলাম ‘তালি’ নামে এক জায়গায়। এখানে একটি তালপুকুর থাকার জন্যই এমন নাম। এখানেও তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস করা যায়। তবে আর মাত্র চার কিমি রাস্তা পেরিয়ে চিত্রখানায় রাত্রিযাপন এক চিরস্মরণীয় ব্যাপার। চার দিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি প্রাঙ্গণ। তৃতীয় দিন আমাদের একটু খাড়াই পথ অতিক্রম করতে হবে। তাই অযথা সময় নষ্ট না করে সকাল সকাল রওনা দিলাম। আজ মাত্র ১০ কিমি পথ অতিক্রম করে আমাদের পৌঁছতে হবে খুলেরা কুঁয়ারির পাশের বেসক্যাম্পে। অল্প রাস্তা হলেও এই পথে কিছু কিছু বিপজ্জনক স্থান অতিক্রম করতে হয়।
নন্দাদেবী, হাতি-ঘোড়া, দ্রোণাগিরি ও ত্রিশূল। শৃঙ্গগুলিকে কখনও বাঁ দিকে, আবার কখনও পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম। পথে কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হলেও মোটের উপর নির্বিঘ্নেই আমরা পৌঁছলাম খুলেরায়। খুলেরা ময়দান শেষ হতেই সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তুষারাবৃত নন্দাদেবী। তার এক দিকে দ্রোণাগিরি, আর এক দিকে ত্রিশূল শৃঙ্গ। খুব তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ায় খুলেরার চার পাশে একটু ঘোরাঘুরি করে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলাম। আগামী দিনের যাত্রাপথের হদিস নিতে নিতেই রাতের খাবার শেষ করে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে পড়া। আগামী দিনের আলো ফোটার আগেই আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে কুঁয়ারি পাস-এর উদ্দেশে। খুলেরা থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার রাস্তা হলেও পথ যথেষ্ট কঠিন এবং খুলেরা থেকে প্রায় ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হবে। এর পর কুঁয়ারি পাস অতিক্রম করে আমাদের দাকোয়ানি পৌঁছতে আরও প্রায় ৮ কিমি পথ অতিক্রম করতে হবে। কুয়ারি পাস অতিক্রম করে দাকোয়ানি পৌঁছনোর রাস্তা বেশ বিপজ্জনক। আমাদের সঙ্গে দু’জন সিনিয়র সদস্য থাকায় আমরা ঠিক করলাম, কুঁয়ারি পাস ও কুঁয়ারি টপ পর্যন্ত পৌঁছে আবার আমরা একই পথে ফিরে আসব খুলেরায়।
পর দিন সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম মূল গন্তব্যের দিকে। কিন্তু কিছুটা রাস্তা এগোতে না এগোতেই বুঝতে পারলাম, কী পথ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! মাত্র এক কিমি পথ চলার পরই বরফে মোড়া রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু। প্রথমে নরম বরফ থাকায় খুব একটা অসুবিধায় না পড়লেও, চলার গতি কিছুটা কমে গেল। আর নরম বরফ দিয়ে বেশ কিছুটা এগনোর পরই এই অভিযানের সব চেয়ে কঠিন রাস্তার মুখোমুখি হলাম প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তার পুরোটাই কাচের মতো স্বচ্ছ আর বরফমোড়া। একটু অসতর্ক হলেই পা ফসকে সোজা কয়েক হাজার ফুট গভীর খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
আমাদের গাইড আইস-অ্যাক্স দিয়ে শক্ত বরফ ভেঙে রাস্তা তৈরি করতে করতে এগিয়ে চলল। আর অত্যন্ত সতর্কতায় আমরা গাইডের দেখানো সেই রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট কিছু বিপদ পেরিয়েও কুঁয়ারি পাস অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম কুঁয়ারি টপ-এর দিকে। টপ-এ পৌঁছনোর রাস্তা খুব বিপজ্জনক না হলেও প্রায় চার ফুট জমে থাকা নরম বরফ টপকে এক সময় আমরা পৌঁছলাম কুঁয়ারি টপ-এ। নরম বরফে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়া মাত্র ৭০০ মিটার রাস্তা পেরোতে আমাদের সময় লাগল প্রায় চল্লিশ মিনিট!
কুঁয়ারি টপ-কে চার দিক থেকে ঘিরে রেখেছে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গের সারি। এখান থেকে দেখা যায় পৃথিবীখ্যাত নীলকণ্ঠ, চৌখাম্বা, নন্দাদেবী, দ্রোণাগিরি, ত্রিশূল, হাতি-ঘোড়া সহ আরও বেশ কিছু নামী-অনামী পর্বতশৃঙ্গকে। বেশ কিছুটা সময় টপ-এ কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে তা সম্ভব হল না। তাই মাত্র মিনিট পনেরো কাটিয়েই, ফ্লাস্কের চায়ের গরম শরীরে নিয়ে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করলাম আমরা। আজই খুলেরা ছেড়ে নীচের দিকে নামব। তাই খুলেরায় দুপুরের খাওয়া শেষ করে রায়গোরির পথে রওনা দিলাম আর যাত্রাপথে ১০ কিমি রাস্তার পুরোটাই উতরাই হওয়ায় সন্ধ্যা নামার আগেই পৌঁছে গেলাম। এই গ্রামের প্রধানের সৌজন্যে ওখানকার একটি স্কুলঘরে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হল। রাতে স্কুলবাড়ির প্রাঙ্গণে গ্রামবাসীদের উপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হল ক্যাম্পফায়ার। আর সকালে গ্রামবাসীদেরই দেওয়া চা-বিস্কুট-বাদাম খেয়ে স্কুলপড়ুয়াদের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে স্কুলঘর পরিষ্কার করে বেরিয়ে পড়লাম তপোবনের উদ্দেশে। সেখান থেকে গাড়িতে সোজা যোশীমঠে ফিরে এলাম। যদিও ফেরার সময় রায়গোড়ির তাবৎ গ্রামবাসী আর স্কুলপড়ুয়ার হাত নেড়ে বিদায় জানানোর ছবিটুকু যেন আবারও এই পথে ফিরে আসার এক উষ্ণ আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল!
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে হরিদ্বারগামী যে কোনও ট্রেনে হরিদ্বার। সেখান থেকে গাড়ি
অথবা বাসে জোশীমঠ। সেখান থেকে গাড়িতে আউলি। আউলি থেকে হাঁটা শুরু।
কী কী নেবেন
ভাল শীতপোশাক, তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, টর্চ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ।
কবে যাবেন
মে থেকে জুন অথবা অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই পথে যাওয়া যেতে পারে।
কোথায় থাকবেন
আউলির পর এখানে রাত কাটানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে সঙ্গে তাঁবু নিয়ে যাবেন।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.