সিনেমা সমালোচনা...
দুর্ঘটনা! দায়ী অভিনেতা শিবপ্রসাদ
দু’টি দুর্ঘটনা, মৃত দুই।
দুর্ঘটনায় জখম সাত।
ধৃত অটোচালক।
ট্রাক উল্টে মৃত তিন।
‘অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবিটা যেদিন মুক্তি পেল, উপরের এই হেডিংগুলো তার ঠিক আগের দিন আর পরের দিনের কাগজ থেকে তুলে দিয়েছি।
ছবির পর্দায় পরিচালক নন্দিতা রায় আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ২০০৮ থেকে ২০১১-র মধ্যে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি পথ দুর্ঘটনা এবং সেগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে উঠে আসা গুচ্ছ গুচ্ছ তথ্যই এ ছবির আকর। ২০১২-র পুজো আসতে চলল, এ রাজ্যে অ্যাক্সিডেন্ট-এর গ্রাফ কিন্তু নামেনি। তার সঙ্গে যোগ করুন, এই মুহূর্তের বাসভাড়া বিতর্ক। আর নিশ্চয়ই ‘প্রাসঙ্গিক’ বা ‘সময়োচিত’ টাইপের বিশেষণগুলো এ ছবি সম্পর্কে আলাদা করে লেখার দরকার নেই? স্টার্ট নেওয়া হয়ে গিয়েছে, এ বারে চলুন অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে সাঁ করে ছবিটার মধ্যে ঢুকে পড়ি।
অ্যাক্সিডেন্ট-এর গল্পের কেন্দ্রে আছে প্রাইভেট বাসের ধাক্কায় একটি শিশুর মৃত্যু। কার দোষে মারা গেল ছেলেটি? জনতা মারধর লাগিয়ে ড্রাইভারকে পুলিশে দিল। ড্রাইভারের দোষ? ট্রিপ নিয়ে রেষারেষি, ওভারটেকিং, গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলা এ সব দোষ তার আছে ঠিকই। কিন্তু এই শিশুটির মৃত্যু কি সেই কারণে হল? না। তা হলে? মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পথচারীর দোষ’। কিন্তু বাসটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল, ব্রেক ঠিক মতো কাজ করছিল না। বাসমালিক জানত, গা করেনি। মোটর ভেহিকল্স জানত, কিন্তু ছাড়পত্র দিতে কসুর করেনি। যে কোম্পানির তৈরি বাস, তারাও জানত। তা হলে দোষ কার? এই সব প্রশ্ন আর উত্তরগুলো হাতড়ে টেনে বার করে এনেছে এই ছবির চরিত্ররা। স্পষ্ট করে বললে, এ ছবির তিন প্রধান চরিত্র। মৃত ‘বাবাই’য়ের বাবা (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়), ড্রাইভার (রুদ্রনীল ঘোষ) আর ইনসিওরেন্স ইনভেস্টিগেটর (দেবশঙ্কর হালদার)।
এই রকম একটা প্লটে নানা রকম চরিত্র, তাদের জমজমাট কনফ্লিক্ট এবং হাইপিচ ইমোশন সব ক’টাই মিলেমিশে থাকতে পারে। ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবিটা থ্রিলারধর্মী হওয়ার চেষ্টা করেনি। বাকি থাকল, কনফ্লিক্ট আর ইমোশন। এ ছবি সে দু’টোকেই আঁকড়েছে। তাতে এমনিতে অসুবিধে নেই। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় হল বলুন তো? কনফ্লিক্টের কিছু অংশ চমৎকার উতরোল, ইমোশনের বেশির ভাগটাই আলুনি পান্তা হয়ে রইল। তার একটা বড় কারণ অবশ্যই অভিনয়ের খামতি (বাবাইয়ের মায়ের চরিত্রে সম্পূর্ণা লাহিড়ী আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আরও অনেক অনেক ঘষামাজার প্রয়োজন ছিল। শিবপ্রসাদের অভিনয় স্টাইল অনেকটা অনিল চট্টোপাধ্যায়কে মনে করায় বটে। কিন্তু স্টাইলটুকুই। শিবপ্রসাদ পরিচালনাতেই পুরো সময়টা দিন না!)। সেই সঙ্গে চিত্রনাট্য এবং সংলাপও নিজের দায় একেবারে এড়াতে পারে না।
রেজাল্ট? ছবির তাল কেটে গেল।
অ্যাক্সিডেন্ট
রুদ্রনীল, খরাজ, কাঞ্চনা, কাঞ্চন

বাসে উঠলে কখনও দেখবেন, শামুকের গতি! যাত্রীদের কেউ চাপড়ে দেবেন টিনের দেওয়াল, “টানো টানো, বাসটা টানো! বাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার ডাকছ না কি?” কখনও হুল্লাট ‘রেস’! নামতে চাইলে বিরক্ত, “জলদি করুন, জলদি করুন!” পাশাপাশি ছুটন্ত বাস গায়ে গায়ে লেগে যায় আর কী!
অ্যাক্সিডেন্ট-এ র্যাশ ড্রাইভিং নেই বটে, কিন্তু ইঞ্জিন মাঝেমধ্যেই বিগড়েছে। কোনও সিন খরাজ মুখোপাধ্যায় (বাসমালিক) টেনে দিচ্ছেন, কোনও সিন দেবশঙ্কর ফাটিয়ে দিচ্ছেন, কোথাও রুদ্রনীল মাত করছেন! কাঞ্চনা মৈত্রের অভিনয় অসাধারণ। টালিগঞ্জে আজকাল অনেক অন্যরকম ছবি হচ্ছে। এই ধরনের ছবিতে কাঞ্চনার মতো অভিনেত্রীকে আরও ব্যবহার করলে ভাল লাগবে। এঁদের অভিনয়ের জন্যই ছবিটা প্রাণ পেয়ে যাচ্ছে! বাসটা যেন তিন-চারটে স্টপ তরতর করে এগোচ্ছে! কিন্তু যেই ওঁরা পর্দা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, ছবি আবার ঝুলছে। বাসমালিক-ড্রাইভার-কন্ডাক্টর (কাঞ্চন মল্লিক)-প্রতিযোগী ড্রাইভার (শঙ্কর দেবনাথ)-বাসস্ট্যান্ড এই জায়গাগুলো সবচেয়ে সুনির্মিত। বাড়িতে খেতে বসে বউয়ের (কাঞ্চনা মৈত্র) কাছে গর্জে উঠছেন রুদ্রনীল, “আমি পাঁচ ট্রিপ কার্তিক। আমি চার চাকা চালাই রে!” সিনটা মনে থাকবে। এই ছবি করার জন্য রুদ্রনীল বারো দিন কলকাতা শহরে বাস চালিয়েছেন। কিন্তু ছবিতে বেশির ভাগ জায়গায় সেই অনুশীলনের ছাপ বোঝা গেল না। পরিচালক কী বলবেন?
মনে থাকবে দেবশঙ্করকে। মনে থাকবে রুদ্রনীলকে শাসানোর দৃশ্যে খরাজকে। পরিবহণ মন্ত্রীর ভূমিকায় বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী এবং বাস কোম্পানির চেয়ারম্যানের চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তীর বিরাট কিছু করার ছিল না। তবে গল্পে চরিত্র দু’টো গুরুত্বপূর্ণ। প্রতীকীও।
প্রতীক-টতিক আবার কেন, ভাবছেন তো? না না, একটু হালকা টাচ! মন্ত্রীকে চেয়ারম্যান বলছেন, “ক্যাডার নামিয়ে দিন না!” মন্ত্রী বলছেন, “মানুষ পরিবর্তন চাইছে। এখন নিজেদের পরিবর্তন করে নেওয়াই ভাল।” ‘পরিবর্তন’ হল, মামলায় হারল গাড়ি কোম্পানি। চেয়ারম্যানকে শুনতে হল, “দেখলেন তো, সাধারণ মানুষ চাইলে...!”
সাধারণ মানুষ চাইলেই সব সম্ভব, এই রকম একটা থিওরি ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবিতে আছে। থিওরি থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য হওয়া চাই তো! ইচ্ছাপূরণের গল্প বলুন, আশাবাদের গল্প বলুন, ক্ষতি নেই! কিন্তু এত সরলীকরণ কেন? ওই যে কনফ্লিক্ট আর ইমোশনের কথা বলছিলাম! কনফ্লিক্টের নির্মাণটা বেশ ভাল ছিল, কিন্তু রেজোলিউশন-পর্বটা এমন মোটা দাগের হল কী করে? কে বা কারা শিবপ্রসাদকে ঠেঙিয়ে কম্পিউটার ভেঙে দিল, রুদ্রনীলের বাড়ি জ্বালিয়ে দিল, দেবশঙ্করের মেয়েকে কিছু ক্ষণের জন্য তুলে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখাল। বাধাবিপত্তি বলতে এই। এ বাদে ওঁরা তিন জনে সব রকম তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে ফেললেন, রেষারেষি ভুলে ড্রাইভার-কন্ডাক্টররা ভাই-ভাই হয়ে গেলেন। পুলিশ-প্রশাসন-ইউনিয়ন-বাসমালিক সব্বাই আঙুল চুষতে থাকল। দু’বছরের মধ্যে মামলা চুকেবুকে গিয়ে দেবশঙ্করের ইস্কুল যাওয়া মেয়ে একেবারে আমেরিকায় পড়তেও চলে গেল! শিবপ্রসাদ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন! উরিত্তারা!
ক্যামেরা আর সম্পাদনার কাজ আহামরি নয়। জয় সরকারের সুরে শ্রীজাতর লেখা গানগুলো খারাপ নয়। কিন্তু ‘হৃদমাঝারে রাখব’ গানটা কেন? এক্কেবারে মানাইছেনা রে!
তাহলে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ দেখবেন কেন? তিনটে কারণে। এক, ইচ্ছে, মুক্তধারা, অ্যাক্সিডেন্ট পরপর খুব জরুরি কতকগুলো বিষয় ছবিতে আনলেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ। সেটাকে বাহবা দেবেন বলে। দুই, বেশ কিছু ভাল অভিনয় দেখবেন বলে। আর তিন, কলকাতার প্রাইভেট বাস নিয়ে আপনার-আমার সবার অজস্র অভিজ্ঞতা-গল্প-স্মৃতি ছিল, আছে, থাকবে। ছোটবেলায় বাসের টিকিট জমানো! দড়ি টেনে ঘন্টি মারা! ‘আস্তে লেডিজ’ হাঁক! সেই জগৎটাকে পর্দায় একবার ছুঁয়ে দেখবেন না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.