দুপুর থেকেই নিউ টাউন থানার সামনে সাজ সাজ রব। কখন হুটার বাজিয়ে আসবে পুলিশের কনভয়। আর সেই কনভয় থেকে নামবেন থানার নতুন দারোগা। এই দারোগাকে খুশি করতে পুলিশকর্মীরা থানায় এনে রেখেছেন এক বাক্স চকোলেট।
মুখে মাস্ক, কোলে চড়ে
থানায় ঢুকছে ছোট্ট দারোগা। |
বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের চমক। সঙ্গে কান ফাটানো মেঘ-গর্জন। এই ঝঞ্ঝার মধ্যেই ঠিক তিনটে দশ মিনিটে নিউ টাউন থানায় ঢুকল পুলিশের কনভয়। তার প্রথম গাড়ি থেকেই নামলেন থানার নতুন দারোগা। পুলিশের কোল থেকে মায়ের কোলে, তার পরে ছোট্ট একটা লাফ মাটিতে। দারোগা হওয়ার স্বপ্ন এ বার একেবারে বাস্তব।
কেমোথেরাপির জন্য সাত বছরের খুদে দারোগা সুরজ বিনবংশীর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। নতুন দারোগার মাথায় তাই তাড়াতাড়ি করে দারোগার টুপি পরিয়ে দিলেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার সন্তোষ নিম্বলকর। এক্কেবারে পুলিশের পোশাকে, বুটজুতো পায়ে গম্ভীর মুখে গুটি গুটি সুরজ এগিয়ে গেল দারোগার ঘরের দিকে। নিউ টাউন থানার অন্দরে তখন নতুন খুদে দারোগাকে এক বার দেখার জন্য পুলিশ অফিসার থেকে কনস্টেবল সকলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
কিন্তু নতুন দারোগা বলে কথা, তাকে অভ্যর্থনা তো করতে হবে। নিউ টাউন থানায় সব সময়েই মৃদু আওয়াজে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে। গান বন্ধ করে মাইকে ঘোষণা হয়ে গেল, নতুন দারোগাকে স্যালুট করতে সবাই যেন শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়ান। দারোগা সাহেব তার ঘরে দায়িত্ব বুঝে নিয়েই চলে আসবেন স্যালুট গ্রহণ করতে। ঘোষণা শুনে সব পুলিশ অফিসারই তটস্থ হয়ে উঠলেন।
এ দিকে তখন নিজের ঘরে ঢুকে বেশ গম্ভীর ভাবে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে সুরজ। বিশাল রিভলভিং চেয়ারে বসে তার চোখ সামনে রাখা কম্পিউটার মনিটরে। সেখানে ফুটে উঠছে থানায় কোন ঘরে কী রয়েছে। ডেপুটি কমিশনার সন্তোষ নিম্বলকর এক এক করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কোন ঘর কোন দিকে। কোথায় অভিযোগ নেওয়ার ঘর, আর কোথায়ই বা থানার লক-আপ। কয়েদিদের ঘরে যাওয়ার জন্য আগে থেকে এক বার অনুরোধও করে রাখলেন পুলিশ অফিসাররা। গম্ভীর ভাবে তখনই তাতে সম্মতি জানিয়ে দেয় সুরজ। |
|
|
উর্দি-টুপি পরে চেয়ারে বসার পরে আসল রিভলভার নেড়েচেড়ে দেখা। |
|
নতুন দারোগার জন্য একটা খেলনা পিস্তল বরাদ্দ থাকলেও ছিল সত্যিকারের আগ্নেয়াস্ত্রও। টেবিলে রাখা ছিল একটা রিভলভার, একটা নাইন এম এম পিস্তল ও একটা রাইফেল। খুদে দারোগাকে প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছিলেন পুলিশ অফিসাররা। রিভলভার হাতে নিয়ে এই প্রথম মৃদু হাসি ফুটল সুরজের। পুলিশ অফিসাররাও যেন খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
সন্তোষ নিম্বলকর বললেন, “স্যার, আপ ইয়াদ রাখিয়ে আপ কিসিসে কম নহি। আপ কাম কিজিয়ে। হামলোগ আপকে পিছে হ্যায়।”
স্টেজ-থ্রি ক্যানসারে আক্রান্ত সুরজের স্বপ্নকে এ ভাবেই সত্যি করে দিলেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অফিসারেরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছোট্ট ছেলের ইচ্ছাপূরণে কোনও রকম খামতি রাখেননি তাঁরা। এমনকী, ছোট্ট
লক-আপে বন্দিদের সঙ্গে একটু আলাপ। |
হাতে সুরজ ফাঁকা রিভলভারের ট্রিগার টিপতেই সবাই হাততালি দিয়ে উঠলেন। সুরজও জানিয়ে দিল, “ডাকুকো খতম করনেকে লিয়ে পুলিশ বনা হুঁ।” সুরজের পাশে দাঁড়ানো মা সুনীতা তখন আঁকড়ে রয়েছেন ছেলের হাত।
ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের বিছানায় ধুঁকতে ধুঁকতে নিজের এই স্বপ্নের কথা মা-বাবাকে বলেছিল সুরজ। একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুরজের স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব নেয়। এ দিন যখন সুরজ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারদের স্যালুট নিচ্ছিল, সুনীতাদেবীর চোখেও তখন টলটল করছে জল।
স্যালুট নেওয়ার শেষে সুরজ ঘুরে এল থানার লক-আপে। থানায় ঘুরতে ঘুরতেই অসুস্থ সুরজের হঠাৎ কাশির দমক। তার মুখে মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হল সঙ্গে সঙ্গে। এ বার ফেরার পালা। ফের বৃষ্টির মধ্যে হুটার বাজিয়ে কনভয় রওনা দিল সুরজের গন্তব্যস্থল, ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের উদ্দেশে। হুটারের আওয়াজের সঙ্গে তখন মিশে যাচ্ছে মেঘের গর্জন। |