পরিবহণে মাৎস্যন্যায়, মন্ত্রিগোষ্ঠীর ভূমিকায় প্রশ্ন
মর্ঘটের অপেক্ষা নেই। স্রেফ জ্বালানি-খরচের ধাক্কাতেই একের পর এক বাস পাট গোটাচ্ছে রাস্তা থেকে। অটো চলছে মর্জিমাফিক, অনেক জায়গায় তারা ভাড়াও বাড়িয়ে নিয়েছে ইচ্ছেমতো। মওকা বুঝে দাঁও মারছে ট্যাক্সি। এমনকী, যাত্রীদের অসহায়তার ফায়দা লুটতে বহু প্রাইভেট গাড়িও ইদানীং নিয়মিত চড়া দরে ‘খেপ খাটছে’ বলে অভিযোগ।
সব মিলিয়ে নগরের পথে ভোগান্তির একশেষ আমজনতার।
এরই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, পরিবহণের বিবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর গড়ে দেওয়া ‘মন্ত্রিগোষ্ঠী’ তা হলে কী করছে? বস্তুত পরিবহণমন্ত্রীর মতো মন্ত্রিগোষ্ঠীরও আদৌ কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না, সে ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেছেন বাস-ট্যাক্সিমালিকদের একাংশ। এরই মধ্যে রাজ্য সরকার পরিবহণের একটি উপদেষ্টা কমিটিও গড়েছে, যার চেয়ারম্যান করা হয়েছে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায়কে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবারই পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে এ কথা জানিয়ে দেন। “মন্ত্রিগোষ্ঠী পেয়ে আমার দফতর উপকৃত হয়েছে। মুকুলবাবুর মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে পেয়ে আরও উপকার হবে।” বলেন মদনবাবু।
লোকসানের ভারে ন্যূব্জ সরকারি পরিবহণের এমনিতেই বেহাল দশা। তার উপরে বেসরকারি গণ-পরিবহণও যে কতটা পঙ্গু হয়ে পড়ছে, পরিসংখ্যানেই তা পরিষ্কার। মালিক সংগঠনের তথ্য বলছে, বছরের গোড়ায় কলকাতা ও শহরতলিতে বেসরকারি বাস চলত প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার। জুন-জুলাইয়ে তা নেমে আসে ১০ হাজারে। আর গত মাসে ডিজেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা বাড়ার পরে বাস চলছে সাকুল্যে সাড়ে সাত হাজার! অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক। মিনিবাসও তা-ই। বছর শুরুতে মহানগরের পথে হাজার আড়াই মিনি চললেও এখন সংখ্যাটা দেড় হাজারের বেশি নয় বলে সংগঠনের দাবি।
এবং সরকারি তরফে ভাড়া বাড়ানোর কোনও ইঙ্গিত এখনও নেই। ফলে মালিকেরা বলছেন, “ধর্মঘটের আর দরকার কী? সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিও অনর্থক। ভাড়া না-বাড়লে বাস এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।” জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট্সের তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের দীপক সরকারের দাবি, ডিজেলের দাম বাড়া ইস্তক দৈনিক বাসপিছু লোকসান গড়ে তিনশো টাকা বেড়েছে। ওঁদের আক্ষেপ, “অন্তত ভাড়াবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পেলেও কিছু দিন
বাস চালানো যেত। সরকারের ভাবগতিক দেখে মালিকেরা ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলছেন।”
অথচ পরিবহণশিল্পের সঙ্কট সামাল দিতেই মুখ্যমন্ত্রী গড়ে দিয়েছেন মন্ত্রিগোষ্ঠী। যার তিন সদস্য হলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত ও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বলা হয়েছিল, বাস-মালিকদের ভাড়াবৃদ্ধির দাবি যাচাই করে তাঁরা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করবেন। সেইমতো সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। শুধু তা-ই নয়, ভর্তুকির খুঁটি সরিয়ে সরকারি পরিবহণকে চাঙ্গা করা, নতুন বাস কেনা, বেসরকারি বাসের স্বাচ্ছন্দ্যবৃদ্ধি কিংবা অটোর ভাড়া ও দাপট নিয়ন্ত্রণের উপায় খোঁজার ভারও বর্তেছিল মন্ত্রিগোষ্ঠীর হাতে।
নিষ্পত্তির প্রতীক্ষায়
• বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সির ভাড়াবৃদ্ধি
• অটো-রাজ নিয়ন্ত্রণে বিধি
• কর্পোরেট বাস চালানোর প্রক্রিয়া
• পরিবহণ নিগমে ভর্তুকি রদ
• নিগমে বেতন-পেনশনে নিশ্চয়তা
• নিগমের পড়ে থাকা জমি বিক্রি
• পথে নতুন বাস নামানো
কিন্তু প্রায় দু’মাস ধরে তিন-তিন বার বৈঠক করেও কোনও সমস্যার কোনও সমাধান-সূত্র তারা বাতলাতে পারেনি। উল্টে সরকারের নানা টালবাহানায় সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ। বাসের দুর্দশা তো বটেই, অটোরিকশার সাম্প্রতিক চালচলন ও ট্যাক্সির ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ যার বড় উদাহরণ। অভিযোগ: সরকারি সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগে অটো ইউনিয়নগুলো নিজেদের মতো করে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। বহু জায়গায় পাঁচ জন সওয়ারিও তুলছে।
পুলিশ ব্যবস্থা নিলে অবরোধে বসে পড়ছেন চালকেরা। আবার ট্যাক্সিচালকদের একাংশও পরিবহণ-সঙ্কটের ফায়দা লুটতে মাঠে নেমে পড়েছেন। যাত্রী-প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি তাঁরা ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকছেন বলে অভিযোগ। কলকাতা পুলিশের এক ট্র্যাফিক-কর্তার কথায়, “সরকার যতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে, তত সমস্যা বাড়বে পুলিশের। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা রয়েছে প্রতি পদে।”
এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি পরিবহণ-মালিকদের অনেকের প্রশ্ন, “মন্ত্রিগোষ্ঠীর কি আদৌ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে? নাকি শুধু সময় নষ্টের উদ্দেশ্যেই মন্ত্রিগোষ্ঠী?” উল্লেখ্য, পরিবহণমন্ত্রীর ‘এক্তিয়ার’ সম্পর্কেও বিভিন্ন মহলে একই সংশয়ের সুর বিভিন্ন সময়ে শোনা গিয়েছে। যেমন, অটোশাসনের লক্ষ্যে তাঁরই গড়ে দেওয়া কমিটি এক মাস আগে রিপোর্ট পেশ করলেও মদনবাবু তা কার্যকর করতে পারেননি। বিবেচনার জন্য তিনি সেটি মন্ত্রিগোষ্ঠীকে পাঠিয়েছেন। মন্ত্রিগোষ্ঠীও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
একই ভাবে পরিবহণ নিগমে বেতন-পেনশন সম্পর্কেও মন্ত্রিগোষ্ঠী সিদ্ধান্তে আসতে না-পারায় কর্মীরা হতাশ। “ভেবেছিলাম, মন্ত্রিগোষ্ঠী আমাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবে। সেই চেষ্টাও
কেউ করলেন না! ওঁদের আসলে কোনও ক্ষমতাই নেই!” মন্তব্য উত্তরবঙ্গ পরিবহণ নিগমের এক ইউনিয়ন নেতার।
মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্যেরা অবশ্য এমনটা মানতে নারাজ। ওঁদের দাবি, তাঁরা সমস্যা সুরাহার চেষ্টা করছেন। শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবু বলেন, “বাস-মালিকদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। অটো নিয়েও রিপোর্ট জমা পড়েছে। আমরা সবটাই দেখছি।” তবে মালিকেরা ভাড়া না-বাড়লে বেসরকারি পরিবহণের ‘মৃত্যুর’ আশঙ্কা করলেও পার্থবাবু ভাড়াবৃদ্ধির কথা এক বারও বলছেন না। বরং তাঁর বক্তব্য, “আমরা বিকল্প উপায়ে বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সির আয় বাড়াতে চাইছি। দেখা হচ্ছে, গাড়িতে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা যায় কি না। নতুন বাস-ট্যাক্সি কেনায় ভর্তুকিও বাড়ানো হয়েছে।” পরিবহণ-মন্ত্রিগোষ্ঠীর আর এক সদস্য, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র অবশ্য বলেন, “আমি ঠিক পরিবহণটা দেখি না।”
এই ‘টালবাহানা’ দেখে বাস-মালিকেরা হতাশ। জয়েন্ট কাউন্সিলের সম্পাদক সাধন দাসের অভিযোগ, “মন্ত্রিগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল। ওঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না! এটা দুর্ভাগ্যজনক।” আবার বাস-মালিকদের অনেকে অটোর মতো নিজেরাই ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন। সংগঠনের এক নেতার কথায়, “অনেক রুটে বাসকর্মীরা যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া দিতে অনুরোধ করছেন। অধিকাংশ যাত্রী দিচ্ছেনও।”
যাত্রীরা রাজি হলেও সরকার অবশ্য অনড়। এ হেন সঙ্কটকালেও পরিবহণমন্ত্রী এ দিন ভাড়াবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেননি। বরং দায়িত্বটা তিনি ঠেলে দিয়েছেন ‘অভিভাবক’ মন্ত্রিগোষ্ঠীর উপরে। মদনবাবুর মন্তব্য, “পরিবহণের সার্বিক উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের লক্ষ্যেই মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়া হয়েছে।”
কিন্তু মন্ত্রিগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য তো সমস্যার সুরাহা! তার কী হল?
মদনবাবুর জবাব, “আমি তা কী করে বলব! মন্ত্রিগোষ্ঠীই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.