|
|
|
|
তিন বছর পরে লালগড়ের পুজোয় রাবণ পোড়া |
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা
কিংশুক গুপ্ত • লালগড় |
এক বছরেরও বেশি হিংসা থেমেছে । মাথা চাড়া দিতে পারেনি অশান্তি ডেকে আনা শক্তি। যেন তারই প্রতীক হিসেবে তিন বছর পরে এ বার দুর্গাপুজোয় ফের ‘রাবণ পোড়া’ উৎসবে মাতবে লালগড়।
অকাল বোধন করে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিলেন রামচন্দ্র। রাবণ বধ হয়েছিল দশমীতে। সে জন্য দুর্গাপুজোর দশমীর সন্ধ্যায় ঘটা করে বহু জায়গায় হয় রাবণ দহন। রাবণের একটি বড় কাঠামো তৈরি করে তার মধ্যে ঠেসে দেওয়া হয় নানা ধরনের বাজি। রাবণ পোড়া শুরু হলে সেই বাজি ফাটতে থাকে সশব্দে। এই উৎসব মূলত উত্তর ভারতের হলেও পশ্চিমবঙ্গের লালগড়, খড়্গপুরের মতো বেশ কিছু জায়গায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এই প্রথা।
লালগড় শেষ ‘রাবণ পোড়া’ দেখেছে ২০০৮-এর পুজোয়। সে বছরই নভেম্বরে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয় তাক করে মাওবাদীদের ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ এবং তার জেরে লালগড়ে আদিবাসী মহিলাদের উপরে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ তুলে শুরু হয় লালগড় আন্দোলন। |
|
তিন বছর পরে লালগড়ে ফের তৈরি হচ্ছে রাবণ। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি। |
অচিরেই জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপের অন্যতম ভরকেন্দ্রে পরিণত হয় লালগড়। পরের তিন বছর লালগড়ে দুর্গাপুজো হয়েছে। ‘রাবণ পোড়া’ হয়নি। স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকাবাসীদের অনেকের উৎসাহ যেমন ছিল না, তেমনই পুলিশ-প্রশাসন অনুমতি দেয়নি।
স্থানীয় এক প্রশাসনিক কর্তা বলেন, “রাবণ পোড়া উৎসবে খোলা জায়গায় এক সঙ্গে অনেক মানুষ জড়ো হন। সেই সঙ্গে রাবণ পোড়ার সময়ে বাজির প্রচণ্ড শব্দ হয়। সেক্ষেত্রে নাশকতা করার সুযোগ তৈরি হয়। বাজির শব্দের আড়ালে কেউ গুলিগোলা ছুড়তে পারত। এই এলাকাতে গত তিন বছরে পরিবেশ অশান্ত ছিল, তাতে সেই আশঙ্কাতেই রাবণ
পোড়া উৎসবের অনুমোদন দেওয়া হয়নি এতদিন।”
সেই অশান্ত পরিবেশ তৈরি হওয়া ইস্তক লালগড় থানা এলাকায় প্রায় ৫০ জন খুন হয়েছেন। নিখোঁজও প্রায় সমসংখ্যক। লালগড়ে শেষ খুন ২০১১-র জুনে। মাওবাদীরা জড়িত, এলাকায় এমন শেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা ২০১১-র অগস্টে, যখন করমশোল জঙ্গলে তাদের গুলিবৃষ্টিতে জখম হন এক কোবরা জওয়ান। তার পর থেকে দেড় লক্ষ মানুষের বসবাসের জায়গা সাতটি পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত লালগড় এখনও পর্যন্ত শান্ত, রক্তপাতহীন। লালগড় থানার আইসি সমীর কোপ্তির কথায়, “এলাকা এখন শান্ত। ফলে, এ বার পুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাবণ পোড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।” যে কারণে, রাবণ পোড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিরাট মেলা বসে, তারও অনুমতি এ বার দেওয়া হয়েছে। এক দিনের ওই মেলায় এলাকার প্রায় পনেরো
বিশ হাজার মানুষ আসেন। তবে পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, গোটা উৎসবের উপরে কড়া পুলিশি নজরদারি অবশ্য থাকবে। |
|
২০০৮ সালে লালগড়ের কাক চরা ডাঙার মাঠে রাবণ। ফাইল চিত্র। |
শুধু তাই নয়, আগে যে রাবণের উচ্চতা থাকত ৫০ ফুটের মধ্যে, এ বার তার উচ্চতা ৬০ ফুট।
বাঁশের মূল কাঠামোর উপরে কাগজের মণ্ড, রঙিন কাগজ ও বাঁশের টুকরো দিয়ে তৈরি সেই রাবণের গোটা শরীর ঠাসা থাকবে বোমা ও পটকায়।
লালগড় যুব সংস্থার উদ্যোগে লালগড় সর্বজনীন দুর্গোৎসব এ বার ৬৩ বছরে পড়ল। তাঁরাই আয়োজন করতেন ‘রাবণ পোড়া’। আগে হত দশমীর সন্ধ্যায় স্থানীয় কাকচরাডাঙা ময়দানে। তবে সেই মাঠে তিন বছর আগে তৈরি হয়েছে সিআরপি-র শিবির। তাই, ‘রাবণ পোড়া’ ও সেই উপলক্ষে মেলা এ বার হবে লালগড় সজীব সঙ্ঘের মাঠে, যেখানে ইদানীং সরকারি উদ্যোগে ফুটবল খেলা হচ্ছে। সিঁদুর খেলার পরে দশমীর সন্ধ্যায় দুর্গা প্রতিমাকে স্থানীয় লাইব্রেরি মাঠের মণ্ডপ থেকে বার করে এলাকায় পরিক্রমা করানোর পরে সজীব সঙ্ঘের মাঠে নিয়ে যাওয়া হবে। তার পরে দুর্গতিনাশিনীর সামনেই হবে ‘রাবণ পোড়া’।
পুজো কমিটির সম্পাদক তাপস অধিকারী বলেন, “যেখানে পুজোর বাজেট (এ বছর সর্বোচ্চ) ৩ লক্ষ টাকা, সেখানে রাবণ পোড়ার খরচই ৫০ হাজারেরও বেশি। শুধু রাবণের বাজির জন্যই বরাদ্দ ৩০ হাজার।” পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এ বার রাবণ পোড়ার সময় ৬৫ ডেসিবেল শব্দ-সীমা কী ভাবে মানা যাবে, সেটাই প্রশ্ন।”
এর আগে সাত বছর ধরে রাবণ তৈরি করে আসা শিল্পী লক্ষ্মীকান্ত দাস এ বারও বরাত পেয়েছেন। বছর সাতাশের লক্ষ্মীকান্তবাবু পেশায় বিএসএনএলের ঠিকাকর্মী। ২০০৮-এ পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৩৫০০ টাকা। এ বার পারিশ্রমিক ৫০০ টাকা বেড়েছে। শিল্পীর কথায়, “আবার রাবণ তৈরি করতে পারছি, সেটাই সব চেয়ে আনন্দের।”
লালগড়ের বাসিন্দা বৃদ্ধা খাদি চালকের বক্তব্য, “পরিস্থিতি বদলেছে, এ বার রাবণ পোড়া না হলে ছেলেপুলেরাই লঙ্কাকাণ্ড বাধাত।” |
|
|
|
|
|