উপেক্ষার ছক ভাঙার সিঁড়ি চ্যাম্পিয়ন্স লিগই
ক রাতের অঘটনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়া টিমকে উদ্দেশ করে গত পরশু কোচ ডানকান ফ্লেচার তখন ভারতীয় ড্রেসিংরুমে বলতে উঠেছেন। প্রথমেই তিনি বলেন, “আমি এখানে এক জনের নাম দিয়ে শুরু করতে চাই যে আমাদের সতীর্থ। একমাত্র সতীর্থ যে গোটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জুড়ে খেলার সুযোগ পায়নি। কিন্তু মন দিয়ে প্রতিদিন ট্রেনিং করেছে। টিমের সঙ্গে থেকেছে। আমি জানি এটা কতখানি যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতা। কিন্তু মনোজ তিওয়ারি যে এটা করেছে তার জন্য সবার সামনে আমি মুক্তকণ্ঠে ওর প্রশংসা করতে চাই।”
হাতে রইল পেনসিল-এর মতোই মনোজ তিওয়ারিরও হাতে রইল কোচ ডানকান ফ্লেচারের সর্বসমক্ষে পিঠ চাপড়ানি। এ বারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে হতভাগ্য ভারতীয় ক্রিকেটারের দ্বীপভূমি থেকে আর পাওয়ার কিছুই নেই। ধোনির ভারত দু’টো ওয়ার্ম আপ মিলে সাতটা ম্যাচ খেলেছে। একমাত্র মনোজকেই তার একটাতেও খেলার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়নি। ধোনি তাঁর ঘনিষ্ঠ শিবিরে নাকি ব্যাখ্যা করেছেন, গোটা টিম এমন চাপের মুখে যে আমার কিছু করার ছিল না। বীরুর রান নেই। গম্ভীরের রান নেই। এই অবস্থায় মিডল অর্ডারে আমার ঝুঁকি নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না।
আক্ষরিক অর্থে এটা মানতে অসুবিধে নেই। কিন্তু বাস্তবার্থে আছে। ক্যাপ্টেন যদি মনে করে কাউকে সে বাদ দিচ্ছে অনন্যোপায় হয়ে, সেই বাদ দেওয়াতে তার নিজেরও খারাপ লাগছে, তখন মাঠের বাইরে সে তার জন্যই সবচেয়ে স্নেহের কুশন বিছিয়ে রাখে। হয় ক্যাপ্টেন কাজটা করে। নয়তো কোচ। বছরখানেক আগে রবি শাস্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফরে দলের ম্যানেজার, দু’টো টেস্টেই টিম থেকে বাদ যান দু’জন সিনিয়র। দু’জনেই মিডল অর্ডার ব্যাট। পাঁচ বোলার নামাতে গিয়ে যাঁদের জায়গা করা যায়নি। কিন্তু কোচ সারা দিন এই দু’জনের সঙ্গে কাটাতেন। এক জনের নাম ভিভিএস লক্ষ্মণ। অন্য জন যুবরাজ সিংহ।

কলম্বোয় পৌঁছনোর দিন। গোটা বিশ্বকাপে অবশ্য
বসেই রইলেন মনোজ তিওয়ারি। ছবি: এএফপি
মনোজকে শ্রীলঙ্কায় একেবারেই তা করা হয়নি। সৌরভ প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে দলে ঢুকে যে পরিবেশ পেয়েছিলেন, সেটার তো তবু ব্যাখ্যা হয়। ফ্রেশাররা সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই অল্পবিস্তর র্যাগিংয়ের সামনে পড়ে। কিন্তু থার্ড ইয়ারে উঠে? সেঞ্চুরি করা, বল হাতে উইকেট নেওয়ার পরেও র্যাগিং চলছে, এমন কোথায় কখন হয়েছে?
শ্রীলঙ্কা সফরে একে তো ম্যাচ পাননি। বেশির ভাগ দিন নেটে ব্যাট করতে দেওয়া হয়েছে সবার পরে। কোনও কোনও দিন এমনও হয়েছে, নেটে ব্যাট করতে ঢুকছেন, পাশ থেকে নিয়মিত কোনও ক্রিকেটার ঢুকে সেই নেটের দখল নিয়ে নিয়েছেন। এমন তো নয় যে মনোজ কোনও জুনিয়র ক্রিকেটার। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি জাতীয় দলের ক্যাম্পাসে। কাঁহাতক সহ্য করবেন। এক দিন ফেটে পড়ে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করে ফেলেছিলেন। মামলা কোচ-ক্যাপ্টেন পর্যন্ত গড়ায়। জনশ্রুতি, মনোজ নাকি সরাসরি ধোনির কাছে জানতে চান, আমায় তুমি খেলাচ্ছ না কেন? অধিনায়ক যা ভাল ভাবে নেননি বলে অন্দরমহলের খবর।
টিমের সঙ্গে জড়িত এক জন বললেন, “এ সব ব্যাপারগুলো ইচ্ছে করে করা হয়। তিলে তিলে অবাঞ্ছিত প্লেয়ারের জন্য এমন অবস্থা করা হয় যাতে সে ফোঁস করে ওঠে। আর তখনই টিম ম্যানেজমেন্ট কায়দা করে ধারণা ভাসিয়ে দেয়, অমুকের শৃঙ্খলাজনিত ইস্যুতে সমস্যা। তখন আর নির্বাচকেরাও তাকে স্পর্শ করে না। সংশ্লিষ্ট প্লেয়ারকে ছেঁটে ফেলার ছক সফল হয়ে যায়।” এই ভদ্রলোকের টিপস অনুযায়ী, মনোজের এখন থেকে উচিত হবে সফরে তাঁর ওপর যত অবিচারই হোক, একেবারে রিঅ্যাক্ট না করা। বিপক্ষ তো ঠিক এটাই চাইছে। তোমাকে চটিয়ে দিতে। তাঁর পরামর্শ, যাবতীয় তাচ্ছিল্যকে প্যাড আপ করে ছেড়ে দিতে হবে। ব্যাটে খেলেছ কি আরও গভীর গাড্ডায় চলে গেলে।
আর এক অন্তঃপুরবাসীর কথা অনুযায়ী, ইন্ডিয়া টিম আধুনিক সময়ে এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যেখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করার মতো অবস্থায় নেই। অস্ট্রেলিয়ায় গো-হারান হেরে আসা ইস্তক টিমের ভেতরটা নড়ে গিয়েছে। এক জন সাফল্য পেলে আর এক জনের মনে হচ্ছে তার অস্তিত্বের সঙ্কট এসে গেল। এমনও নাকি হয়েছে, টিমের কোনও প্লেয়ার তাঁর বন্ধুকে বলেছেন, রুম সার্ভিসে তোর যখন ডিনারের অর্ডার দিচ্ছিস আমারটাও দে। প্লেয়ার তখন অর্ডার করেছে নিজের জন্য গ্রিলড চিকেন (ফ্যাটহীন স্বাস্থ্যকর)। আর বন্ধুর জন্য তাকে না জানিয়েই চিকেন বাটার মশালা (সামান্য ফ্যাটযুক্ত আর ভাজা খাবার)। হয়তো কাহিনি সত্যি। এটাও হয়তো সত্যি যে সংশ্লিষ্ট প্লেয়ার এত কিছু ভেবে অর্ডার করেনি। নিছকই হয়তো ভেবেছে যে, আমার শুকনো শুকনো গ্রিল খাওয়ার বাধ্যবাধকতার সঙ্গে ওর না-ও মিলতে পারে। তাই হয়তো চিকেন বাটার মশালার অর্ডার।
কিন্তু পারিপার্শ্বিক সে ভাবে দেখেনি। দেখেছে, প্রতিদ্বন্দ্বীর যদি এক সেন্টিমিটারও ক্ষতি করার সুযোগ পাই, তা হলে করেই ছাড়ব। এত কোটি কোটি টাকা আর চুক্তি এসে হাজির হয়েছে আইপিএল-উত্তর ভারতীয় ক্রিকেটে, যে সংসারটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে।
• শেষ ওয়ান ডে বনাম শ্রীলঙ্কা, পাল্লেকেলে,
৪ আগস্ট ’১২। স্কোর ৬৫।
• শেষ টি-টোয়েন্টি বনাম নিউজিল্যান্ড,
চেন্নাই, ১১ সেপ্টেম্বর ’১২। ব্যাট পাননি।
• শেষ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
(ওয়ানডে), চেন্নাই, ১১ ডিসেম্বর ’১১, ১০৪ ন.আ.।
• পরের ম্যাচ খেলেন সাড়ে সাত মাস বাদে।
• সেরা বোলিং ৪-৬১ বনাম শ্রীলঙ্কা
৩১ জুলাই, ’১২।
• ওয়ান ডে ৮, রান ২৫১, সর্বোচ্চ
১০৪ ন.আ., গড় ৩৫.৮৫, স্ট্রাইক রেট
৭৭.৪৬, উইকেট ৫, গড় ৬.৮৫।
আধুনিক ক্রিকেটারকে এজেন্টরা তৈরিও করছেন এই বদলে যাওয়া সংসার আর মিডিয়াময় পৃথিবীর যোগ্য করে।
অজিঙ্ক রাহানে থেকে উমেশ যাদব। মনদীপ সিংহ থেকে রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ভারতীয় ক্রিকেটের জেনারেশন এক্স যাঁর এক রকম হাতে, মুম্বই নিবাসী এজেন্ট সেই অতুল শ্রীবাস্তব তাঁর সংস্থায় উঠতি ক্রিকেটারদের জন্য ডিজাইনার আর চর্মরোগ বিশেষজ্ঞর ব্যবস্থা রেখেছেন। ডিজাইনার বলে দেবে সে কী ধরনের পোশাক কী ভাবে পরবে। কোথায় কী ভাবে নিজেকে ক্যারি করবে। স্কিন স্পেশ্যালিস্ট নিয়মিত ভাবে ত্বকের সুরক্ষা দেখেন। যাতে রোদ্দুরে খেলতে খেলতে চামড়া এমন কুঁচকে না যায় যে, ভবিষ্যতে এনডোর্সমেন্ট বাজারে অসুবিধে হল। অজিঙ্কের মতো যাঁরা ইংরেজিতে শুরুতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না তাঁদের জন্য আছেন ইংরেজি শিক্ষক। তিনি স্পোকেন ইংলিশ অভ্যেস করান। আর এক জন আছেন যিনি মিডিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য আদানপ্রদান নিয়মিত অনুশীলন করান। অনূর্ধ্ব উনিশরাও এখন থেকে শিখছে কী ভাবে তার অপছন্দের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে মিডিয়া উত্তেজক প্রশ্ন করলে সেই বলটা ঠিকঠাক নামাতে হবে!
মনোজ তিওয়ারি এমন একটা সময়ের। যা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর অজিঙ্ক রাহানের মধ্যবর্তী যুগ। এজেন্টের আধুনিক এ সব ট্রেনিংয়ে তিনি অভ্যস্ত নন। তিনি বোঝেন রান। সেঞ্চুরি করার পরেও ১৫টা ইনিংস বসে থাকায় বোলিংয়ে যত্ন নেওয়া শুরু করেন। সেখানেও ওয়ান ডে আন্তর্জাতিকে সফল। গত অগস্টে এই শ্রীলঙ্কা এসেই শেষ ওয়ান ডে ম্যাচে তাঁর রান ৬৫। টি-টোয়েন্টি বলতে যদি আইপিএল ফাইনালের শেষ ওভারে রুদ্ধশ্বাস চাপ নেওয়া হয়, তা হলে সেখানেও দুর্দান্ত সফল।
এর পরেও যদি অবিচার আর তাচ্ছিল্য দেখে তাঁর মাথা গরম হয়, খুব দোষ দেওয়া যায় কি? ছকটা তো তিনিই বুঝে গিয়েছেন। বসাতে বসাতে আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়া অবস্থাতে হঠাৎ করে এক দিন খেলিয়ে দেওয়া হবে। এই মানসিকতায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তখন বলে দেওয়া যাবে, দিয়েছিলাম তো সুযোগ। পারল না দেখলেন! এ জন্যই এত দিন খেলাইনি।
বিক্ষত মনোজের প্রথম এগারোয় ফিরে আসার সেরা পাদানি এখন দক্ষিণ আফ্রিকার আসন্ন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সচিন তেন্ডুলকর এবং তিনি একই রকম উৎসুক চোখে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। দু’টো ভিন্ন কারণে। সচিন রওনা হয়ে যাচ্ছেন শুক্রবার। আর মনোজ তিনিও হয়তো চলে যাবেন দল পৌঁছে যাওয়ার আগেই। আনন্দবাজারকে জানালেন, আগে গিয়ে আলাদা ট্রেনিং করবেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু শহরগুলোর জন্য। যেমন জো’বার্গ। টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পরেও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট দল ঘোষণার আগে পড়ে থাকল রঞ্জি, দলীপ এবং ইরানি ট্রফি। কিন্তু বিজ্ঞাপন এজেন্সির ভাষায় ‘ব্র্যান্ড রিকল’ সবচেয়ে বেশি থাকা উচিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের। এখানে গরম-গরম খেলে দিতে পারলে ক্রিকেটদুনিয়াকে দেখিয়ে দেওয়া যাবে, কলম্বোয় তাঁকে আগাগোড়া বসিয়ে রেখে ধোনি কী রকম অবিচারটাই না করেছেন!
তফাতের মধ্যে এ বার মনোজের সঙ্গে আছেন তাঁর অধিনায়ক। গৌতম গম্ভীর অধিনায়ক হলে কলম্বোয় অন্তত দু’টো ম্যাচে সুযোগ পেতেন মনোজ। গম্ভীর মনে করেন মনোজ দারুণ ক্রিকেটার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাঁকে চার নম্বরের মধ্যে ব্যাট করতে পাঠাবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন।
তাচ্ছিল্য থেকে স্নেহের গ্রহে এসে মনোজ যদি বাইশ গজে ফেরার পাদানিটা আবার পান!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.