বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্কট কাটিতেছে না। অটলবিহারী বাজপেয়ীর অবসরগ্রহণের পর তাঁহার যে বর্ষীয়ান সহকর্মী একদা বিজেপিকে একটি প্রান্তিক রাজনৈতিক সংগঠন হইতে জাতীয় শাসক দলে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন, সেই লালকৃষ্ণ আডবাণীরও বানপ্রস্থে গমনের সময় হইয়া গিয়াছে। তবু যে তিনি এখনও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সামলাইবার চেষ্টা করিয়া যাইতেছেন, তাহার কারণ, অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব এখনও সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল না। গোধরা ২০০২ নরেন্দ্র মোদীর পিছু ছাড়িতেছে না। ঠিক যে কারণে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অনুঘটক রামজন্মভূমি আন্দোলনের নেতা হওয়ায় আডবাণীর গ্রহণযোগ্যতা এক সময় এনডিএ-র শরিকদের কাছে তলানিতে ঠেকিয়াছিল যাহার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ‘অবসর’ হইতে বাজপেয়ীকে ফিরাইয়া আনিতে হয় একই কারণে নরেন্দ্র মোদীর গ্রহণযোগ্যতাও এনডিএ শরিকদের কাছে সংশয়ান্বিত। বস্তুত, মোদী তাঁহার স্বভাবের কারণে নিজ দলের অনেক সহকর্মীর কাছেও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য নহেন।
এই অবস্থায় হিন্দুত্ব-রথের আদি-রথী লালকৃষ্ণ আডবাণী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধ্বজা ধরিয়া এনডিএ-র শরিকদের আশ্বস্ত করিতে সুরযকুণ্ডে দলের জাতীয় সম্মেলনে অবতীর্ণ হইলেন। ইতিহাসের পরিহাস বটে। কিন্তু দলের বৈঠকে নিজের লিখিত ভাষণে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার’ অঙ্গীকারটি শেষ অবধি আডবাণী পাঠ করেন নাই। অনুমান করা যায়, উপস্থিত শ্রোতাদের উষ্মা উৎপাদনের আশঙ্কায়। ইহা তাৎপর্যপূর্ণ। হিন্দুত্বের মায়া হইতে দলকে উদ্ধার করিয়া একটি আধুনিক, সংস্কারমুখী কর্মসূচির ভিত্তিতে তাহার পুনর্নির্মাণের কর্মসূচি আজও দল আবিষ্কার করিতে পারে নাই। যে দল একদা বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ‘শাসন-পরিচালনার স্বাভাবিক সংগঠন’ হইয়া উঠিয়াছিল, এখন তাহার একমাত্র কাজ দাঁড়াইয়াছে একের পর এক সংসদের অধিবেশন ভণ্ডুল করা অর্থাৎ শাসন চলিতে না দেওয়া। যে শাসন করিতে চায়, তাহাকে বিরোধী পক্ষে থাকিলেও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হয়। সংসদের বাহিরে যে সব কর্মসূচি দলের তরফে লওয়া হইতেছে, তাহাতেও অন্য রকম দল রূপে বিজেপিকে গণ্য করার সম্ভাবনা কম, বরং কংগ্রেসেরই একটি মলিন প্রতিচ্ছবি বা দুর্বল সংস্করণ বলিয়া বোধ হয়। যে সব প্রশ্নে বিজেপি অতীতে সংস্কারের পক্ষে মত দিয়াছে, এখন সেগুলিও তাহাদের প্রতিবাদের শিকার। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের এমন নজির ভারতেও দৃষ্টিকটু।
এই সঙ্কটের একটি বড় কারণ, নাগপুরের সরসংঘচালকদের কর্তৃত্বে হইতে মুক্ত হইয়া বিজেপি স্বাধীন অস্তিত্বে স্থিত হইতে পারে নাই। ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্গমেয়াদি সাফল্য চাহিলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রাজনৈতিক বাহু হইয়া থাকার নিশ্চিন্ততা দলীয় নেতা-কর্মীদের পরিহার করিতে হইবে। বিজেপিকে যদি পুনরায় শাসন-সঞ্চালনের স্বাভাবিক পার্টি হইয়া উঠিতে হয়, তবে সঙ্ঘ পরিবারের জুরাসিক দাওয়াই বর্জন করিয়া নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির চোরাবালি হইতে দেশকে বাহির করার তত্ত্বে ফিরিতে হইবে। একটি আধুনিক, সংস্কারমুখী, বাজারতাড়িত অর্থনীতিই জনমুখী শাসনপ্রণালীর মূল কথা। বাতিল ধ্যানধারণার নিগড়ে দলকে বাঁধিয়া না রাখিয়া ভবিষ্যমুখী আদর্শের অভিমুখে চালিত করিয়াই বিজেপি আপনাকে নূতন যুগধর্মের সহিত প্রাসঙ্গিক করিয়া লইতে পারে, খুচরো পণ্যে বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে ভারত-বন্ধ ডাকিয়া তাহা সম্ভবপর নহে। |