সম্পাদকীয় ১...
বন্দরের কাল
সুকুমার রায় প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ বলিয়া দিয়াছিলেন: সব ভগ্নাংশ, ত্রৈরাশিকের হিসাব কষিবার পর হাতে শুধু পেন্সিলটুকুই অবশিষ্ট থাকিবে। বাঙালি নিজ চেষ্টায় সেই পেন্সিলখানিও বঙ্গোপসাগরের জলে বিসর্জন দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করিয়াছে। হলদিয়া বন্দর গত এক মাস পশ্চিমবঙ্গ-ছাপ ট্রেড ইউনিয়নের দাপাদাপি দেখিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শ্রমিক সংগঠনগুলি পরস্পরের বিরোধী তো বটেই, একই দলের ইউনিয়নের বিভিন্ন গোষ্ঠীও একে অপরের প্রতিস্পর্ধী। সকলেই অবশ্য ‘শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা’ করিতেছে! সেই স্বার্থরক্ষার দাপটে বন্দরের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ‘ব্যবসা চাহি না, আন্দোলন সামলাও’ বলিয়া দক্ষিণমুখে জাহাজ ভাসাইয়াছে। ওড়িশার পারাদীপ বা ধামড়া বন্দর তাহাদের গন্তব্য। জাহাজগুলিতে যে কাঁচামাল আসিতেছে, তাহা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারখানাতেই ব্যবহৃত হইবে। পশ্চিমবঙ্গ যে অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে, তাহাতে এই রাজ্যে আর কত দিন শিল্পের কাঁচামাল আনিবার প্রয়োজন থাকিবে, তাহা একটি প্রশ্ন বটে কিন্তু সে প্রশ্ন আপাতত থাক। পারাদীপে মাল নামাইয়া রেলপথে তাহা পশ্চিমবঙ্গে আনিতে বিলক্ষণ অনেক বেশি খরচ পড়িবে। কিন্তু সংস্থাগুলি তাহাতেও রাজি। তাহারা উন্মত্ত হলদিয়ার অনিশ্চয়তায় জড়াইতে চাহে না।
বন্দরে জাহাজ কমিলেও ‘শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার আন্দোলন’ থামিবে না বলিয়াই অনুমান। অনুমানটি ভিত্তিহীন নহে স্বার্থরক্ষার নামাবলি গায়ে যে বিবিধ রাজনৈতিক সমীকরণের নিষ্পত্তি হলদিয়ায় চলিতেছে, তাহার নোঙর বন্দরের স্বার্থে বাঁধা নাই। সেই রাজনীতির সুরটি নিখাদ বঙ্গজ কে শত্রু তাহা জানা নাই, ফলে ঘরে-বাহিরে নিজেদের মারিয়া চলাই নিয়তি। এই নিয়তি লঙ্ঘন করিবে কে? মুশকিল হইল, জাহাজই যদি না আসে, তবে আর বন্দর থাকে কী উপায়ে? বন্দর না থাকিলে কর্মরত শ্রমিকও নাই। শ্রমিক না থাকিলে তাঁহাদের স্বার্থ নাই। শ্রমিকের স্বার্থই যদি না থাকে, তবে বামপন্থীরা কী রক্ষা করিবেন, আর তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীই বা কী লইয়া আত্মকলহ করিবে? শূন্য হইতে শূন্য বিয়োগ করিলে কত পড়িয়া থাকে, তাহা বুঝিতে গণিতজ্ঞ হইতে হয় না, দার্শনিকও নহে। পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি সেই অনন্ত শূন্যের অন্তঃস্থলে অবস্থান করিতেছে। কোনও ভগীরথের সাধ্য নাই, উন্নয়নের গঙ্গা নামাইয়া এই রাজ্যকে উদ্ধার করেন।
আজকের হলদিয়া সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের রূপক। যে বন্দরের প্রতিশ্রুতি ছিল তাহা পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের প্রবেশদ্বার হইবে, সেই বন্দর হইতেই রাজ্যের সর্বনাশের শেষ জাহাজ ছাড়িতেছে। এবং, যে মারণ রোগটি অবশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গকে শেষ করিয়াছে, তাহাই হলদিয়াতেও প্রাণান্তক হইয়াছে। রোগটি আত্মঘাতী রাজনীতির। এই রাজনীতির কোনও বৃহৎ লক্ষ্য নাই, কোনও মহতের সাধনা নাই। ক্ষুদ্রতাই ইহার সার। যে রাজনীতি রাজ্যকে শিল্পহীন করে, তাহা শ্রমিকের স্বার্থে হইতে পারে না। গোট দক্ষিণবঙ্গ শিল্পশ্মশানে পরিণত হওয়ার পরেও বাঙালি এই কথাটি বুঝিল না, রাজনীতির এমনই আকর্ষণ! সিঙ্গুরের স্মৃতি এখনও মিলাইয়া যায় নাই। পশ্চিমবঙ্গে থাকিতে কার্যত নাছোড় একটি শিল্পকেও কী ভাবে রাজনীতির কুলার বাতাস দিয়া রাজ্যের সীমানা পার করাইয়া দেওয়া যায়, সিঙ্গুর সেই সাক্ষ্য বহন করিতেছে। তাহার ফল কী হইয়াছে, বাতিল কারখানার বন্ধ দরজার সম্মুখে বসিয়া থাকা মুখগুলির শূন্য দৃষ্টি সেই প্রশ্নের জবাব দিবে। বাঙালি তবু শিখে নাই। মুখ্যমন্ত্রীর শিল্পের জন্য জমির ব্যবস্থা না করিবার জেদে বাঙালি এখনও হাততালি দেয়। শিল্পবিরোধী ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনকে রাজনীতির পরাকাষ্ঠা জ্ঞান করে। এই বাঙালির এই হলদিয়াই প্রাপ্য। এই বাঙালির এই পশ্চিমবঙ্গই প্রাপ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.