তিনি যা বলবেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা গিলবেন উপস্থিত শ্রোতা। এমনটাই তো হয়েছে বরাবর। এ বারে তবে হল কি? তুখোড় বাগ্মী হিসেবে পরিচিত তিনি প্রতিপক্ষকে এমন অনায়াসে খেলতে দিলেন কী ভাবে?
মঙ্গলবার রাতে ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগনেস এরিনা যে বারাক হুসেন ওবামাকে দেখল, তাঁকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে বিস্ময় আর খানিক অবিশ্বাস মেশানো এই প্রশ্নগুলোই।
মেরেকেটে পাঁচ সপ্তাহ বাকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের। তার আগে মঙ্গলবার রাতেই প্রথম বার মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিলেন দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রিপাবলিকান মিট রোমনি আর ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা।
ঘটনাচক্রে এ দিনই আবার ছিল বারাক আর মিশেলের কুড়িতম বিবাহবার্ষিকী। স্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়েই তাই বিতর্ক শুরু করেছিলেন ওবামা। দেড় ঘণ্টার বাগযুদ্ধের শেষটা অবশ্য খুব একটা শুভ হল না তাঁর পক্ষে। বিতর্ক শেষ করার আগে আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বলে গেলেন, “সবাই জানে, ৪ বছর আগে বলেছিলাম, মানুষ হিসেবে আমার মধ্যে প্রচুর খুঁত আছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তাই আমি নিখুঁত হব না।”
সংস্কারের স্বপ্ন দেখিয়ে চার বছর আগে ক্ষমতায়
আসা ওবামা কি তবে তাঁর ‘ব্যথর্তা’ মেনে নিলেন? শুধু
মাত্র আজকের বিতর্কের উপরে ভিত্তি করে হয়তো তা বলা যায় না। তবে, প্রথম দিনের শেষে কিছুটা ব্যাকফুটেই দেখাচ্ছে ওবামাকে।
কেন? প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রোমনি ‘চ্যালেঞ্জার’। সে ক্ষেত্রে তাঁর আসল কাজ ছিল, আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট পদের যোগ্য দাবিদার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা। নিজের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা প্রতিষ্ঠা করা যে, আমেরিকার সুদিন ফিরিয়ে আনার ‘ব্লু প্রিন্ট’ তাঁর তৈরি আছে। দেড় ঘণ্টায় এই কাজটা সঠিক ভাবে করতে রোমনি অপ্রত্যাশিত রকম সফল বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। ওবামা লড়ছেন পুরনো পদ বাঁচানোর লক্ষ্যে। তাঁর কাজ হওয়া উচিত ছিল রোমনি-র ‘ব্লু-প্রিন্ট’ নস্যাৎ করা। কিন্তু অন্তত প্রথম দিনের সম্মুখ সমরের শেষে দেখা যাচ্ছে, রোমনি কী পরিকল্পনা মাথায় রেখে দেশবাসীকে সুদিনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সেটাই তাঁর থেকে বের করতে পারলেন না ওবামা। প্রতিবারই কৌশলে ওবামাকে এড়িয়ে গেলেন রোমনি। উল্টে ওবামা জমানার নানা ব্যর্থতা এমন ভাবে ব্যবহার করলেন, যার কোনও জলদিজবাব ছিল না ওবামার কাছে। |
টক্কর। ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ে মিট রোমনি ও বারাক ওবামা। ছবি: এ পি |
গোটা সময়টাই এই কৌশলেই ওবামাকে কার্যত বেঁধে রাখেন রোমনি। আমেরিকার বেকারত্ব প্রসঙ্গই ধরা যাক। রোমনি বলেন, “নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করা আমার অগ্রাধিকার। বেশি মানুষ রোজগার করবেন, কর দেবেন। এটাই অর্থনীতি স্থিতিশীল করার সব থেকে উপযোগী পদ্ধতি।” বিরোধিতা করে ওবামা বলেন, “২০০১ আর ’০৩-এ এই পদ্ধতি প্রয়োগ হয়েছিল। লাভ হয়নি। চাকরির সুযোগ বাড়েনি। উল্টে ঘাটতি বাড়ে। এর জন্যই পরে আমেরিকার ইতিহাসের সব থেকে খারাপ আর্থিক দুর্দশাটা দেখতে হয়েছিল আমাদের।” একটুও না দমে রোমনি বলেন, “চার বছর আগে আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অর্থনৈতিক ঘাটতি অর্ধেকে নামিয়ে আনবেন। কিন্তু এখনও আমাদের কোটি কোটি ডলার ঘাটতি!” উল্টো দিকে দাড়ানো ওবামা তখন চুপ! প্রথম দিনের বিতর্ক শেষে রোমনির সার্থকতা এখানেই।
আরও আছে। পরিসংখ্যান বলবে, গোটা বিতর্কটায় রোমনি-র থেকে চার মিনিট বেশি কথা বলেছেন ওবামা। কিন্তু ওবামা কী বলেছেন তার থেকেও বেশি আলোচনায় উঠে আসছে ওবামা কী বলেননি। আর সেই তালিকাটা চমকে ওঠার মতোই। নির্বাচনী প্রচারে যে বিষয়গুলি নিয়ে রোমনির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিল ওবামা-শিবির, আজকের বিতর্কে তার ধারও মাড়াননি ওবামা। এর মধ্যে রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে রোমনির ভূমিকা এবং তাঁর বিরুদ্ধে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ। তোলেননি ‘৪৭%’-এর প্রসঙ্গও। মে মাসে এক গোপন ভিডিও ফাঁস হয়। তাতে শোনা যায় রোমনি তাঁর সমর্থকদের বলছেন, “দেশের অন্তত ৪৭% জনতা দুঃস্থ। এঁরা সরকারি সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল। এঁদের আমাকে ভোট দেওয়ার কথা নয়।” গত দু’সপ্তাহ এই ভিডিও হাতিয়ার করে রোমনির বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ চালিয়েছে ওবামা শিবির। অথচ আজ এ নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি ওবামা। এমনকী, তাঁর জমানার সব থেকে বড় ‘সাফল্য’ ওসামা নিধন নিয়েও কোনও মন্তব্য করেননি ওবামা।
ব্যালট বক্সের হিসেব বলছে রোমনির থেকে সামান্যই এগিয়ে ওবামা। স্বাভাবিক ভাবেই আজকের বিতর্কের পর কিছুটা উজ্জীবিত রোমনি-শিবির। ওবামার ব্যাকফুটে যাওয়া ভাবমূর্তি রোমনির পালে হাওয়া টানবে বলেই মত তাদের। তবে এর বিপরীত একটা মতও রয়েছে। খোদ রোমনি শিবিরের একাংশই আবার বলছে, এই রক্ষণাত্মক ব্যাপারটা আসলে ওবামার কৌশল। ভোটের আগে এখনও আরও দু’বার রোমনিকে সামনে পাবেন ওবামা। প্রথম লড়াইয়ে তাই শুধুমাত্র প্রতিপক্ষকে মেপে নিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ওবামার সেরা অস্ত্রগুলো হয়তো লুকনো রয়েছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় লড়াইয়ের জন্য। আপাতত তাই ১৭ অক্টোবরের দ্বিতীয় বিতর্কের দিকেই নজর সকলের। |