যা ভাবছেন তা নয়! বুধবারের কলম্বোর নিউজমেকার অব দ্য ডে মোটেও ভারত অধিনায়ক বা তাঁর টিম নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক নিরপেক্ষ দেশের মাঠে হওয়া কোনও টুর্নামেন্টে ব্যর্থতার পরে এই প্রথম গণবিক্ষোভের ভয়ে তাঁদের হোটেলের খিড়কির দরজা দিয়ে ঢোকানো হল। আর ওপরে ওঠানো হল সার্ভিস লিফটে। রুম সার্ভিসের লোকজন যে লিফট দিয়ে ওপরে উঠে খাবার সার্ভ করে। শ্রীলঙ্কা টিমও কখনও তাদের নিজের দেশে এমন অবরুদ্ধ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে কি না সন্দেহ।
তবু এ দিন দেশে ফিরে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটারদের থেকে কলম্বোর হেডলাইন সরিয়ে নিয়েছেন ক্রিস গেইল। নিউজমেকার অব কলম্বো বুধবার তিনিই। দশাসই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার মিডিয়াকে কথা দিয়েছিলেন টিম ফাইনালে গেলে টিভি ক্যামেরার সামনে কলম্বোর সেই বিখ্যাত গেইল-ডান্স করবেন। তার আগেই তিনি নবতম বিতর্কে। স্থানীয় পুলিশ থানার বয়ান অনুযায়ী গত কাল মাঝরাতে গেইলের ঘর থেকে তারা তিন ব্রিটিশ মহিলাকে গ্রেফতার করেছে যারা আইসিসি গোয়েন্দাদের নিয়ম ভেঙে রেজিস্ট্রেশন বিনা গেইলের ঘরে চলে গিয়েছিল। এ দিন আদালতে তুলে জামিনে এদের মুক্তি দেওয়া হয়। পুলিশের অভিযোগ, কোনও বিচ পার্টিতে গেছিলেন গেইল। সেখানে এই মহিলারা তাঁর গায়েটায়ে ঢলে পড়ছিল। তখন গেইল নাকি তাদের প্রস্তাব দেন, সমুদ্রের ধারে সময় নষ্ট না করে হোটেল ঘরের নির্জনতায় গিয়ে বসা ভাল। তখন গেইলের সঙ্গেই এরা হোটেলে ঢোকে। ওপরে ঘরে যায়। পুলিশের কাছে হোটেল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী প্লেয়ারের রুমে যাওয়ার আগে এরা নীচে খাতায় নাম এন্ট্রি করেনি। শুক্রবার গেইল সেমিফাইনাল খেলবেন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। এত বড় বিতর্ক ম্যাচের আগেই অস্ট্রেলিয়াকে আচমকা সুবিধে এনে দিল বলে মনে হয় না। কারণ পুলিশি অভিযোগে গেইলকে কোথাও জড়ানো হয়নি। আর গেইলের এজেন্ট আনন্দবাজারকে জানালেন তাঁদের তরফে সরকারি বক্তব্য: মেয়েগুলোকে আমার ঘর থেকে পাওয়া যায়নি। আমি করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওদের দেখতে পাই। এর পর পুলিশ আমার নামটা দিব্যি ব্যবহার করেছে। জানে এতে কাহিনির রং চড়াতে সুবিধে হবে।
ক্রিস গেইল আর মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মধ্যে বুধবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ করা গেল। প্রথম জন কলম্বোর নিউজমেকার। দ্বিতীয় জন কলম্বোস্থিত ক্রিকেটমহলের। শ্রীলঙ্কার স্থানীয় ক্রিকেটার, দেশি-বিদেশি ভাষ্যকার, বিদেশি দলসবার মনে হচ্ছে অধিনায়ক ধোনি তাঁর স্বমহিমা থেকে অনেক নেমে গিয়েছেন। আর টানা যে ভাবে তাঁর ফর্ম নামছে, তাতে উত্তরণ আর সম্ভব বলে মনে হয় না। কলম্বোয় বুধবার সেই এলটিটিই জমানার পর আরও একটা ‘শান্তিচুক্তি’ সম্পাদিত হল। সেটা হল কেভিন পিটারসেন আর ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে। দু’পক্ষ পাশাপাশি বসে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। বোঝাই যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপর্যয়ে এই শান্তিচুক্তি দ্রুতগামী হল। যাই হোক পাশাপাশি বসে ইংরেজ বোর্ড কর্তা জানালেন, পিটারসেনকে চার মাসের চুক্তি দেওয়া হচ্ছে। কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের হাতে সব দায়িত্ব। তিনি যখন মনে করবেন ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমের মধ্যে পিটারসেনকে নেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখনই ফ্লাওয়ার ফিরিয়ে নেবেন।
পিটারসেনকে এখনও নিচ্ছে না ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুম। এ ভাবে মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকলে ধোনি সম্পর্কে কি একই কথা বলত ভারতীয় ড্রেসিংরম? কেননা ভারতীয় ড্রেসিংরুমের মধ্যেও প্রভূত গুঞ্জন, ধোনির কি শেষের শুরু? ০-৮ হারার পর ভারত কেন, পৃথিবীর অন্য কোনও অধিনায়ক পরিত্রাণ পেত না। সেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পর আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ০-৩-এর ধাক্কা। নিছক নেট ফল দেখলে ধোনিবাদ নিয়ে এত বিক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। ভারত টুর্নামেন্টে পাঁচটা ম্যাচের মধ্যে চারটেতে জিতেছে। গ্রুপ ম্যাচের পয়েন্ট ক্যারি ফরোয়ার্ড হওয়ার নিয়ম থাকলে তো তাদের লুকিয়েচুরিয়ে পিছনের সার্ভিস লিফট দিয়ে ঘরে ফিরতেও হয় না।
তবু ধোনিকে নিয়ে কথা উঠছে। কারণ স্ট্র্যাটেজির যে সব ভুল তিনি টুর্নামেন্টে করেছেন সেটা তাঁর কাছে কেউ ভাবতেই পারে না। প্রেমদাসার যে পিচে পাকিস্তান উমর গুলের মতো বোলারকে ১৮ ওভারে বল করতে ডাকে। সেখানে তিনি মাত্র ১২১ হাতে নিয়েও ছয় ওভার পেসারদের দিয়ে করিয়ে গিয়েছেন। স্পিন বোলিংয়ে তাঁর প্রধান অস্ত্র অশ্বিন, সিএসকে-র হয়ে এত ম্যাচে তাঁকে বোলিং ওপেন করিয়েছেন। অথচ কাল বল করতে ডাকেন রোহিত শর্মারও পরে। অশ্বিন তাঁর এক ঘনিষ্ঠর কাছে শুনলাম হাল্কা অনুযোগ করেছেন, “প্রত্যেক ওভারের পর ভাবছি এ বার ডাকবে। এ বার ডাকবে। ১১ ওভারে ডাকবে ভাবতে পারিনি।”
কেন হরভজন সিংহের মতো প্রথম প্রত্যাবর্তন যুদ্ধেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ ছিনিয়ে নেওয়া স্পিনারকে তিনি টিমেই রাখেননি সেটা আর এক রহস্য। নিজেই বলেছেন বৃষ্টির জন্য অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে তাঁর স্পিনাররা বল গ্রিপ করতে পারেনি। তা হলে তো হরভজনের আরও একটা সুযোগ প্রাপ্য ছিল। ব্যাটিংয়ে তিনি নিজে বা রায়না ওপরে না গিয়ে বারবার রোহিত শর্মাকে আগে পাঠালেন। খালি বলে গেলেন, আমার আগে গিয়ে আউট হয়ে গেলে কী হবে? যা শুনে সবার মনে হচ্ছে তুমি টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে-তে এমন তুখোড় ম্যাচ জেতানো প্লেয়ার। তুমি কেবল আউট হওয়ার কথা ভাববে কেন? কেন এত নীচে খেলবে যেখানে আইপিএলে তোমার গাদাগুচ্ছের রান। অথচ ভারতের হয়ে আজ পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটা পঞ্চাশও নেই। ভারতের এ ভাবে টুর্নামেন্ট থেকে খারিজ হয়ে যাওয়াটা চূড়ান্ত দুর্ভাগ্য একমত হয়েও আরও একটা ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত হচ্ছেন।
চিরআক্রমণাত্মক ডাকাবুকো সেই ধোনি এখন ইতিহাস।
নতুন ধোনি রক্ষণাত্মক। দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে ১২১ রানের মধ্যে বেঁধে রাখতে যত উৎসাহী। তার চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মককোনও রকমে জিতে ম্যাচ বার করতে।
টিমের মধ্যেও তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে এত প্রশ্ন, তাঁর পদে টিকে থাকা নিয়ে এত সব জিজ্ঞাসা যে বুধবার দলের সঙ্গে যুক্ত একজন বললেন, “ইউপিএ সরকারেও এতগুলো ভাগ নেই। এই দলে যতগুলো জোট আছে।” এক একটা পার্টির মুখ হলেন কোথাও গম্ভীর। কোনওটার সহবাগ। কোনওটায় যুবরাজ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধোনি বিরোধী শিবিরের শীর্ষনেতারা চূড়ান্ত ব্যর্থ। সহবাগ ৩ ম্যাচে মাত্র ৫৪। গড় ১৮। গম্ভীর ৫ ম্যাচে ৮০। গড় ১৬। যুবরাজের এখন ক্যাপ্টেন্সিতে দাবি থাকারই কথা নয়।
আপাতদৃষ্টিতে ধোনির নেতৃত্বে কোনও যানজটের আশঙ্কাই এখন নেই। তাঁর বিরোধীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর অন্তত ইংল্যান্ড সিরিজ অবধি তো ভারত অধিনায়কের ফ্রি ওয়ে হওয়া উচিত। কোহলি পরিবর্ত হতে পারেন। কিন্তু সে এখন দেরি।
অথচ অধিনায়কত্ব থেকে ধোনিকে সরানো উচিত এমন গুঞ্জন গত ২৪ ঘণ্টায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটমহলে বারবার উঠছে। টিমের মধ্যেও ভীষণ ভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। সৌরভও তাঁর নেতৃত্ব জীবনের শেষ দিকে দলের আনুগত্য হারিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা এই পর্যায়ে নেমে যায়নি। এখুনি দলের মধ্যে গোপন ব্যালট হলে পনেরো জনের দলে ধোনি বড়জোর চার-পাঁচটা ভোট পাবেন। কোথাও একটা ধারণা জন্মাচ্ছে টিমমেটদের যে যোগ্যতা নয়, শ্রীনিবাসনকে ধরে ধরে তিনি গদি রাখছেন। ভাজ্জি আর দিন্দার শেষ দিকে বসে যাওয়ার মধ্যে টিমের মধ্যেই কেউ কেউ বোর্ড প্রেসিডেন্টের হাত দেখছেন। পাকিস্তান ম্যাচের দিন দুপুরে এসেছিলেন শ্রীনিবাসন। আসামাত্র অশ্বিন আর বালাজিদুই তামিলনাড়ু ক্রিকেটার দলে ফেরত আসেন।
পরিস্থিতি এমন অগ্নিগর্ভ যে সুরেশ রায়না অবধি ক্যাপ্টেনের শিবির ছেড়ে এখন বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধানে। যুবরাজ একদিন দেরিতে নামনোয় ছুড়ে হেলমেট ভেঙে ফেলেছেন। আর রায়নাকে পাকিস্তান ম্যাচে নীচে নামানোয় তিনিও হেলমেট ছুড়ে দিয়েছেন। তফাতের মধ্যে তাঁরটা ভাঙেনি। প্রায় পাঁচ বছর দলের অধিনায়কত্ব করছেন ধোনি। গত অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে এই সব ঘটনা শুরু হয়েছে। তার আগে দলটা তাঁর হাতেই ছিল। শোনা যাচ্ছে যার সমর্থনে তিনি ড্রেসিংরুমের ভেতর জাঁকিয়ে ছিলেন এত দিন ভারতীয় ক্রিকেটের সনিয়া গাঁধীও আর সঙ্গে নেই। তিনিসচিন তেন্ডুলকর!
একমাত্র বাঁচোয়া দেশের অধিকাংশ ক্রিকেটবিশেষজ্ঞ এ বার ধোনির বিরুদ্ধে জোরালো কোরাস তোলেননি। গাওস্কর, মঞ্জরেকর, গাঙ্গুলি, শ্রীকান্তসবাই এ বারের মতো বেনিফিট অব ডাউট দিতে চান ভারত অধিনায়ককে। তা নিয়েও টিম ইন্ডিয়ার অন্দরমহলের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছেওদের প্রাণে ভয় আছে না? সদ্য মোহিন্দরের কেসটা দেখল।
ভারতীয় ক্রিকেটের গহন অন্দরমহলে যাতায়াত আছে এমন এক ব্যক্তি বুধবার বললেন, “ধোনির অধিনায়কত্ব হারানোর এখুনি কোনও ভয় নেই। ক’দিনের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শুরু হচ্ছে। জনতা দু’দিন চিৎকার করেই ভুলে যাবে। তার পর ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ জিতে ফেললেই যে কে সেই।” একই সুরে ভারতীয় ক্রিকেটের ওয়াকিবহাল মহলের মত হল, জনরোষ অস্বাভাবিক পর্যায়ে না গেলে ২০১৩-র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধোনির গদি সুরক্ষিত থাকা উচিত। সেপ্টেম্বরে বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে শ্রীনিবাসনের মেয়াদ ফুরোচ্ছে। তখন অবশ্য ধোনিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছাড়বেন, না তাঁকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে?
ক্রিকেটীয় নিরিখে সত্যিই মাফ করে দেওয়া যায় এমন ছিটকে যাওয়া। অথচ ভেতরে এমন লাভা জমা ছিল যে সামান্য চাপেই উদ্গীরণ হচ্ছে। গেইলের ঘরে ব্রিটিশ মহিলারা। পিটারসেনের সঙ্গে ইংল্যান্ড বোর্ড মিলে যাওয়া। এই দু’টো আইটেম তো খুব স্বাভাবিক উপসংহার। ধোনিবাদের বিরুদ্ধে ড্রেসিংরুমের মধ্যেই ধ্বনিবাদ এমন ভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছে সেটা অস্বাভাবিক। |