ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার স্নায়ুকেন্দ্রের কাছে, সংসদ ভবনের অদূরে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সপারিষদ ধর্না অনেকের কাছেই জাতীয় রাজনীতিতে বাঙালির ভূমিকার ইতিবৃত্তের স্মৃতি বহিয়া আনিবে। এবং সেই স্মৃতি খুব উজ্জ্বলতা বা সাফল্যের আখ্যান রূপে সম্ভবত প্রতিভাত হইবে না। রাষ্ট্রগুরু রূপে বন্দিত হইলেও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনওই জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিকে সে ভাবে প্রভাবিত করিতে পারেন নাই, যে ভাবে গোখলে, টিলক বা গাঁধী করিয়াছিলেন। ব্যতিক্রম, অবশ্যই, চিত্তরঞ্জন দাশ। কিন্তু তাঁহার অকালবিদায়ে অনেক সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। তাঁহার সাক্ষাৎ ভাবশিষ্যের ‘দিল্লি চলো’ আহ্বান জনপ্রিয় হইয়াছে, কিন্তু গাঁধীজির নিকট তাঁহার পরাজয়ই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের অঙ্গ। স্বাধীন ভারতে বিধানচন্দ্র রায় কিংবা জ্যোতি বসু আঞ্চলিক নেতার অধিক কিছু হইয়া উঠিতে পারেন নাই। দ্বিতীয়োক্ত জনের সুযোগ আসিয়াছিল, কিন্তু পার্টি সর্বশক্তিমান। অন্য এক বঙ্গসন্তান এই মুহূর্তে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হইলেও তিনি যে রাষ্ট্রনীতিকে কোনও ভাবে প্রভাবিত করিবেন, এমন আশা নাই। জনপ্রতিনিধি হিসাবেও তাঁহার মেয়াদ জাতীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব নির্ণায়ক করিয়া তোলে নাই।
তুলনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার আগুন ও তরবারির দীক্ষালব্ধ সংগ্রামী মনোভাব লইয়া রাজধানীর রাজপথ আলোড়িত করিতে যে তৎপরতা অবলম্বন করিতেছেন, আপাতদৃষ্টিতে তাহার কিছু সম্মোহন ও আকর্ষণ থাকা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান ইউপিএ সরকারের পতন ঘটাইয়া নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী করিয়া তুলিতে সমর্থ হইলেও তিনি জাতীয় রাজনীতিতে কতটা গুরুত্ব পাইবেন, তাহা বলা কঠিন। মুলায়ম সিংহ, নীতীশ কুমার, মায়াবতী, করুণানিধির মতো অনগ্রসর ও দলিত মনসবদারদের প্রত্যেকে নিজেই যেখানে দাবিদার, সেখানে বাঙালি ব্রাহ্মণকন্যার প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাব্য দাবি তাঁহাদের সমর্থন পাইবে কি? আর জাতীয় দলের সমর্থনে কেন্দ্রে সরকার গড়িলে কী হয়, চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া ও ইন্দ্রকুমার গুজরালরা অতীতে তাহা বিলক্ষণ টের পাইয়াছেন। মমতার পক্ষে ইহাও ধরিয়া লওয়া ঠিক নয় যে, বর্তমানে তিনি যে রাজনীতি অনুশীলন করিতেছেন, তাহা সমুদয় বঙ্গবাসীরও সমর্থন পাইবে।
এই রাজনীতি যে সম্পূর্ণ নেতিবাচক, জনতোষিণী ও উন্নয়ন-বিরোধী, তাহা নিয়তই স্পষ্ট হইতেছে। রাজ্যের স্বার্থ যে ইহাতে কোনও ভাবেই সিদ্ধ হইতেছে না, তাঁহার সরকারের জমি-নীতি, লগ্নিকারীর বিনিয়োগ-দ্বিধা এবং পুঁজির পলায়নে তাহা উত্তরোত্তর প্রমাণিত। ইউপিএ কিংবা তাহার আগে এনডিএ সরকারে শরিক থাকা কালেও দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলিয়া ধরার কোনও চেষ্টাই তাঁহার তরফে হইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক প্রাপ্য হইলেও দলের অন্য কোনও বাঙালি নেতার জন্য তাঁহার দাবি বা সুপারিশ ওঠে নাই। রেলমন্ত্রী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিনি কিছু কাজ শুরু করিয়াছেন ঠিকই, কিন্তু তাহা শেষ হইবে কি না, ঘোর সংশয়। পশ্চিমবঙ্গের তথা রাজ্যের বঞ্চনা লইয়াও তিনি এক ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করিয়াছিলেন, কিন্তু ক্ষুদ্র রাজনীতির প্লাবনে তাহাও ভাসিয়া গেল। তাঁহার অব্যবস্থিতচিত্ততার মাশুল গনিতেছে পশ্চিমবঙ্গ, হয়তো আরও অনেক গনিবে। পশ্চিমবঙ্গের ধারাবাহিক অবক্ষয় জাতীয় রাজনীতিতে তাহার শক্তি খর্ব করিয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রান্ত নীতি সেই প্রক্রিয়াকেই জোরদার করিবে। তাঁহার চতুর্দিকে করতালির আওয়াজ প্রবল হইয়াছে, ভোটের বাক্সে সমর্থন বাড়িয়াছে, কিন্তু বাংলার অনুন্নয়নের তিমির বিনাশের কোনও আগমনী শোনা যায় নাই। রাজধানীতে তাঁহার ধর্না এবং প্রাদেশিক নেতাদের সহিত তাঁহার জোট বাঁধার উদ্যোগও তাই শেষাবধি জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার প্রভাব কিছুমাত্র বাড়াইবে বলিয়া ভরসা হয় না। |