মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করলেন না। কিন্তু আজ রাজকোটে দাঁড়িয়ে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নিকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রবল ভাবে সমর্থন করে সনিয়া গাঁধী বললেন: “এত হল্লা কীসের!”
আর আজই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হল, কাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিমা ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি, পেনশন বিল, ফরওয়ার্ড ট্রেডিং বিল ও কোম্পানি বিলে অনুমোদন দিতে পারেন মনমোহন সিংহ।
দু’টি আপাত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। দেশের দুই প্রান্তে এই দুই ঘটনাই বুঝিয়ে দিল আর্থিক সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যেতে অনড় কংগ্রেস তথা ইউপিএ সরকার।
খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির পক্ষে গোড়া থেকেই সওয়াল করছেন রাহুল গাঁধী। কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় কিছুটা হলেও ইতস্তত করছিলেন সনিয়া। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বোঝান মনমোহন। তার পর শরিকি আপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়েছে সরকার। আর সরকারের সিদ্ধান্তের সমর্থনে ভোটের ময়দানে এগিয়ে এসেছেন সনিয়া। আজ তিনি বলেন, “কৃষক ও উপভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতেই বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্র। যদি কোনও মুখ্যমন্ত্রী না চান, তা হলে এই নীতি অনুসরণে তাঁরা বাধ্য নন।” কংগ্রেস সভানেত্রীর বক্তব্য, “কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদনের যথাযথ মূল্য পান তা সুনিশ্চিত হওয়া উচিত। আবার এ-ও দেখতে হবে যাতে ক্রেতাদেরও বেশি মূল্য দিতে না হয় এবং ফড়েরা মাঝখান থেকে মুনাফা লুটতে না পারে। খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে ছাড়পত্র দেওয়ার যুক্তি সেখানেই।” |
সনিয়ার এই সমর্থন স্বাভাবিক ভাবেই শক্তি জোগাচ্ছে মনমোহনকে। সেই জোর থেকেই আগামিকাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আরও এক প্রস্ত সংস্কার প্রক্রিয়াকে ছাড়পত্র দেওয়ার তোড়জোড় করছেন তিনি। যে সব সংস্কারে এত দিন আপত্তি জানিয়ে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফরওয়ার্ড ট্রেডিং সংক্রান্ত বিলটি আটকাতে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন দফায় দফায় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন মুকুল রায়। দু’দিন আগে যন্তর-মন্তরে ধর্না সভাতেও মমতা জানান, পেনশন ও বিমা বিলে আপত্তি করবে তৃণমূল।
কিন্তু সেই বিরোধিতাকে যে তাঁরা পরোয়া করছেন না, সেটা সনিয়া-মনমোহনের আচরণ থেকেই স্পষ্ট। উল্টে সংস্কারের বার্তা যাতে শিল্পমহল থেকে শুরু করে বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে পৌঁছয়, সেই চেষ্টাই ধারাবাহিক ভাবে করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেস ও সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, বিমা বিল নিয়ে বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহের নেতৃত্বে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ইতিমধ্যেই রিপোর্ট পেশ করেছে। স্থায়ী কমিটির কিছু সুপারিশ সরকার মেনেও নিয়েছে। ফলে এই বিলটি সংসদে পাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু পেনশন বিল, ফরওয়ার্ড ট্রেডিং বিল শেষ পর্যন্ত পাশ করানো যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিজেপি সংস্কারের পক্ষে বলে সরব হলেও রাজনৈতিক কারণে শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করতে পারে। তবু এই সব বিল পেশ করে প্রধানমন্ত্রী আসলে সংস্কারের পরিবেশকেই মজবুত করতে চাইছেন। ভর্তুকি ছাঁটাই ও বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ লগ্নিতে ছাড়পত্র দেওয়ায় বাজার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ডলারের নিরিখে টাকার দাম বেড়েছে। এর পর বিমা, পেনশন, কোম্পানি বিল ও ফরওয়ার্ড ট্রেডিং বিলে অনুমোদন দিলে বাজারে সাড়া পড়বে বলেই আশা কেন্দ্রের।
সরকার যাতে সংস্কার কর্মসূচিতে অবিচল থাকে সেই বার্তা দিচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর সুবীর গোকর্ণ আজ বলেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নিতে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু আর্থিক ঘাটতি কমাতে আরও সংস্কার প্রয়োজন। ভর্তুকির বোঝা আরও কমাতে হবে সরকারকে। তবেই জিনিসপত্রের দাম কমে সুদের হার কমানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে।
|
বিদেশি লগ্নির বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য গঠিত দীপক পারেখ কমিটিও আজ বলেছে, টেলিকম ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা ৭৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ মাসুল বৃদ্ধিরও সুপারিশ করেছে তারা। তবে সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপের রাজনৈতিক পরিণতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে কংগ্রেসকে। সে ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হল, সনিয়া তথা কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু আর এখন বিন্দুমাত্র রক্ষণশীল নন। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর গুজরাতের ভোট প্রচারে এফডিআই-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দলনেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন বিরোধীদের আক্রমণ সত্ত্বেও সরকার ভীত নয়। বরং গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি কেন্দ্রের এই নীতির বিরোধিতা করায় আখেরে রাজ্যের কৃষক ও সাধারণ মানুষেরই যে ক্ষতি হবে তাই তুলে ধরতে চাইবে কংগ্রেস। |