|
|
|
|
লুকিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে হোটেলে ঢুকতে হল ধোনিদের |
এক দিনের মধ্যে রাজা বনে গেল ফকির,
ফকির হয়ে গেল কিনা সুলতান |
গৌতম ভট্টাচার্য • কলম্বো |
এখন রাত্তির সাড়ে বারোটা। তাজ সমুদ্র হোটেলের প্রধান ফটকের বাইরে দেড়শো জনেরও বেশি জটলা। ভারতীয় সমর্থক যত সংখ্যায়, তার চেয়েও বেশি পাকিস্তান পতাকা নিয়ে লোক। দু’পক্ষে কিছুটা তর্কাতর্কিও হয়ে গেল। মাঝরাত্তিরে ওখানে এতগুলো পাকিস্তানি পতাকা আর জার্সি পরিহিত লোক দেখে সকলে বিস্মিত। পাকিস্তান তো এই হোটেলে নেই। আছে আধ কিলোমিটার দূরের সিনেমন গ্র্যান্ডে। সেমিফাইনাল যাওয়া দলের প্রতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে এরা ভারতীয় শিবিরে কী করছে?
দ্রুত বোঝা গেল কী করছে। এরা এসেছে ভারতের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে। এদের প্রথম লক্ষ্য বাস থেকে নামা মাত্র মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে বলা, অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। নিজেরা বিদেয় হয়ে গিয়ে কিনা আমাদের সেমিফাইনালে তুলে দিলেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার দিকে যাচ্ছে দেখে একটা পুলিশ বাহিনীও সেখানে এসে হাজির হল। মনে হল হোটেলটা আবার সেই এলটিটিই-র সময়কার অশান্ত শ্রীলঙ্কায় ফিরে গেছে। ততক্ষণে জড়ো হয়ে গেছে প্রচুর টেলিভিশন ক্যামেরা। হঠাৎ বাস এসে দাঁড়াল। সবাই হইহই করে ছুটলেন। কিন্তু বাসের ভেতরটা ফাঁকা। পরে জানা গেল পেছনের দরজা দিয়ে প্লেয়ারদের ঢুকিয়ে পিছনের লিফট দিয়ে ছ’তলার ঘরে চালান করে দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় দলের এ ভাবে খিড়কির দরজা দিয়ে পালিয়ে হোটেল ফেরা এই প্রথম। প্লেয়াররা দেখলাম ঘরে ঢুকেই দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন। বলে দেওয়া হয়েছে আগামিকাল দুপুরের মধ্যে বাপি বাড়ি চলো।
টেস্ট ক্রিকেটে ০-৮ বিপর্যয়ের পরে এ বার টি-টোয়েন্টিতে ০-৩। টানা তিন বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও যেতে ব্যর্থ আইপিএলের জন্মদাত্রী দেশ। পাকিস্তান জয়ের হনিমুন কেটে গিয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে টিম ইন্ডিয়া এখন বিশ্বকাপের আবর্জনায়। কী ভাবে প্রেমদাসার এক দিন ভাগ্য বদলে দেয়! পাকিস্তানযারা গত পরশুও ম্যাচ হেরে ড্রেসিংরুমে নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি করতে গিয়েছিল, তারা কিনা ফকির থেকে রাতারাতি সুলতান। আর ভারত রাজা থেকে ফকির। |
|
কত রকম অন্যায় সুবিধে পেয়েও যে ভারত টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিচ্ছে ভাবাই যায় না। গল্ফে হ্যান্ডিক্যাপ পদ্ধতি হয়েছে যাতে কম দক্ষতাসম্পন্ন খেলোয়াড়ও একই সমতল থেকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে শুরু করতে পারে। এখানে সমদক্ষতাসম্পন্ন হয়েও ভারতকে ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ দেওয়া হয়েছিল। আইসিসি-র বক্স অফিস হল টিম ইন্ডিয়া। তারা চলে গেলে যদি টুর্নামেন্ট বর্ণহীন, নাহঃ! বাণিজ্যহীন হয়ে পড়ে। প্রতি দিন তাই ভারত এক সারফেসে খেলার সুযোগ পেয়েছে। কলম্বোর বাইরে যেতে হয়নি। রাতে পরের ম্যাচ খেলেছে। গাঁধী জয়ন্তীতেও তো আইসিসি-র গাঁধীগিরির সুযোগ পেয়েছে। পরে ম্যাচ থাকায় আগাম জানতে পেরেছে যে, ম্যাজিক ফিগার হল আজ ১২১। এই সংখ্যা বা তার কমে দক্ষিণ আফ্রিকাকে থামিয়ে আজ জিততে হবে। পরে ব্যাট করলে সমীকরণটা ছিল অন্য রকম। তখন দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ১৬ ওভারে তুলে জিততে হত। ভারত ম্যাচ মাত্র এক রানে জিতে সেমিফাইনালের দৌড়ে হেরে গেল ৩০ রানে।
ভারতের মেয়েদের বিশ্বকাপ টিম আগেই বিদায় নিয়েছে। ঝুলন গোস্বামীকে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরানোর পর দল ক্রমশ নামছে। বুধবার কলম্বোয় তারা খেলবে আট বনাম নয় নম্বর দেশের বিজয়ী ঠিক করার ম্যাচে। মেয়েদের ক্রিকেটে একজনকে সরানো থেকে দলের লেখচিত্র হুড়হুড় করে নামছে। আর পুরুষদের ক্রিকেটে বোধহয় একজনকে রেখে দিতে বিপর্যয় অব্যাহত আছে।
নইলে টুর্নামেন্ট জুড়ে ভারত যা স্ট্র্যাটেজির দফারফা করে রাখল, এত খারাপ নমুনা ধোনির ক্যাপ্টেন্সি জীবনেও খুব বেশি নেই। তিনি কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিন ফর্ম্যাটে একই সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে দিতে? নাকি পুরো ম্যানেজমেন্ট গ্রুপটাই বেকার হয়ে পড়েছে?
প্রেমদাসার ঘূর্ণি পিচ রেখে গেল অনেক ঘূর্ণি প্রশ্ন! |
হার-জিত
|
দৌড় শেষ। বিষণ্ণ অধিনায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক রানে জিতেও টি-টোয়েন্টি
বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল ভারত। মঙ্গলবার কলম্বোয়। ছবি: রয়টার্স। |
একই টুর্নামেন্টে ভারত-পাক এমন অদ্ভূত ভাবে দু’জনেই পা-দানিতে ঝুলছে। একজন উঠবে। একজন মরবে। এমন ঘটনা আগের কোনও বিশ্বকাপে কখনও হয়নি। কে-ই বা ভেবেছিল ভারতের কাছে ওই রকম মর্মান্তিক হারে বিধ্বস্ত পাকিস্তান ওয়ার্নার-ওয়াটসনের অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে? পাকিস্তান আচমকা জিতে যাওয়ায় টুর্নামেন্টের শেষ চার বাছাই অপ্রত্যাশিত নানান উদ্বেগ নিয়ে হাজির হয়। একটা টিম ঠিকঠাক সাজানো হলে, তার সব কলকব্জা কাজ করলে, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই পরিস্থিতিতেও ম্যাচ বার করাটা সমস্যা নয়। যেখানে কালিস-আমলারা থেকেও ঘূর্ণি পিচে দক্ষিণ আফ্রিকানদের স্পিন খেলার জাতীয় দুর্বলতা রয়েছে। নেট রান রেট অতি কর্কশ একটা শব্দ। কিন্তু সেটারও প্রতিষেধক ছিল যদি অস্ট্রেলিয়ার মতো ভারতও ‘চোক’ না করে যেত। একে তো সাত ব্যাটসম্যানে বোঝাইয়ের ঠকঠকানি। মার্ক ওয় তো ঠিকই বলেছেন, “ভাই সা-আ-ত ব্যাটসম্যান! টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে নাকি? আমি তো জানতাম এখানে কুড়ি ওভার ব্যাট করতে পাওয়া যায়।”
সেই সাতে বেশির ভাগই নিজের জায়গার জন্য খেলছেন। ধোনি তাঁর ফেভারিট রোহিত শর্মাকে আজ হঠাৎ করে চার নম্বরে পাঠিয়েছিলেন। ডাগআউটে যুবরাজ, রায়না এবং তিনি নিজেতিনটে বিগ হিটারকে বসিয়ে রেখে রোহিত। তা রোহিত ফিরে এলেন ২৭ বলে ২৫ করে। এই রানটাই সৌরভ করলে বলা হত, চূড়ান্ত স্বার্থপর। দেশের স্বার্থ দেখল না! ক’দিন আগে ইংল্যান্ড ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে পিছিয়ে দেওয়া নিয়ে এক সিনিয়র ছুড়ে নিজের হেলমেট ভেঙে দিয়েছিলেন। সেই ক্রিকেটারটি আজকের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ যুবরাজ সিংহ কি না, তার রহস্য হয়তো আরও ক’দিন পরে উন্মোচিত হবে। তবে আজ রাত্তিরে যদি আরও কিছু ভাঙাভাঙির খবর আসে আশ্চর্য হওয়ার নেই। টিমের মধ্যে অনেকেই গরগরে রাগে ফুঁসছেন। আজই তো খেলার আগে হরভজন সিংহের মুখটা জাতীয় সঙ্গীতের সময় যখন ক্লোজ-আপে দেখাল, সেটা ছিল গরগরে রাগ আর বিরক্তিতে গুম। এটা আর পাঁচ দিনের মতো জন গণ শুনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখের চোয়াল নয়। এই চাউনি এমন একটা লোকের যে মনে করছে, দেশের জন্য লড়াইয়ের ফৌজে আজ তাঁর নাম থাকা উচিত ছিল। অন্যায় ভাবে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। |
|
জাহিরের উইকেট। |
ভারতের সব ক’টা ম্যাচই ছিল সন্ধে সাড়ে সাতটায়। আর চূড়ান্ত দল ঠিক হত বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। ধোনি নিজে বারবার বলেছেন, তাঁদের দল গড়ার ক্ষেত্রে মস্ত সুবিধে হল সাড়ে তিনটে থেকে শুরু হওয়া আগের ম্যাচটা দেখে বোঝা যায় বল কী করছে। ঘুরছে, না ঘুরছে না।
আশ্চর্য, আজ প্রথম ম্যাচে যেখানে স্পিনার ম্যান অব দ্য ম্যাচ। যেখানে ঘূর্ণি উইকেটের সামনে অস্ট্রেলিয়া ‘চোক’ করে গিয়ে সেমিফাইনালের সমীকরণটাই সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে, সেখানে ধোনি তিন পেসার খেলালেন। দক্ষিণ আফ্রিকা স্পিন ভয় পায়। ইরফান পাঠানের পনির বাটার মশালা জাতীয় মিডিয়াম পেস নয় জেনেও পাঠান আর জাহিরকেই আক্রমণে রেখে দিলেন।
একে তো তাঁর ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা দেখে সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছেন। নিজে টি-টোয়েন্টিতে টিমের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান নামলেন ১৬ ওভারের মাথায়। আজ যেখানে বেশি রান করতেই হবে। কারণ, ৩১ রানের ব্যবধান চাই। সেখানে তাঁর টিমের এক নম্বর স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে বল করতে দিলেন দশম ওভার। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ৬৮-৩। ম্যাজিক ফিগার ১২১ ক্রমশ কাছে চলে আসছে।
পেস বোলারদের যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ফিল্ড দিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক। একটা সময় তো ইরফান বল করছিলেন ৭+২ ফিল্ড নিয়ে। কিন্তু এটা তো পার্থ নয়, প্রেমদাসা। তা-ও দিনের চতুর্থ ইনিংস খেলা হচ্ছে, তার মানে ৬০ ওভার হয়ে যাওয়ার পর। সেই সময় তিনি স্পিনের ফাঁদ পাতবেন না? রোহিত শর্মাকে বল করতে ডাকবেন অশ্বিনের আগে? কোন ব্যাকরণে ব্যাখ্যা? |
|
হতাশার দুই মুখ। |
ধোনির মধ্যেতাঁর অধিনায়কত্বের ধরনের মধ্যে আসলে একটা জুয়াড়ি সত্ত্বা আছে। তা থেকে ডাকাবুকো নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সেগুলো অতীতে কাজেও দিয়েছে। কিন্তু যেখানে ডাকাবুকো হওয়ার দরকার নেই। পিচই রয়েছে। শুধু ঠিক বোলিং চেঞ্জটা করতে হবে, সেখানে স্রোতের বিরুদ্ধে বাহাদুরি করতে যাওয়াটা আহাম্মকের কাজ। ভারতের ক্রিকেট সমালোচকেরা এবং ক্রিকেট নেশাড়ু মানুষ আগামী ক’দিন একটা আলোচনায় চায়ের কাপে তুফান তুলবে। ঠিক টিম নামালে এবং স্পিনারদের আগে আনলে ১২১ হাতে নিয়েও সেমিফাইনাল যাওয়া যেত কি না।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অবশ্য সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ধোনি তিনি আঁতাতের যুগে ভারত অধিনায়কই থেকে যাবেন।
|
যে অঙ্কে বিদায় ভারতের |
• অস্ট্রেলিয়া: ম্যাচ-৩, জয়-২, পয়েন্ট-৪,
নেট রান রেট- (+) ০.৪৬৪।
• পাকিস্তান: ম্যাচ-৩, জয়-২, পয়েন্ট-৪,
নেট রান রেট(+) ০.২৭।
• ভারত: ম্যাচ-৩, জয়-২, পয়েন্ট-৪,
নেট রান রেট (-) ০.২৭৪।
• দক্ষিণ আফ্রিকা: ম্যাচ-৩, জয়-০, পয়েন্ট-০, নেট রান রেট (-) ০.৪২১।
(ভারতকে সেমিফাইনালে উঠতে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১২১ রান বা তার কমে আটকাতে হত।
সেক্ষেত্রে ভারতের নেট রান রেট চলে যেত পাকিস্তানের উপরে) |
|
|
|
|
|
|