|
|
|
|
সিআরপি-র মাওবাদী-তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন |
সেই মেটালার জঙ্গলে গুলিতে হত ২ জওয়ান |
অভিজিৎ চক্রবর্তী • মেটালা |
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
সময়ের ব্যবধানটা ১০ মাসের। ২০১১-র ১৪ নভেম্বরের পর ২০১২-র ৩০ সেপ্টেম্বর। পুরুলিয়ার বলরামপুরের খুনটাঁড় গ্রামের পর পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ের মেটালার জঙ্গল। পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী-প্রভাবিত জঙ্গলমহলে ফের নিরাপত্তারক্ষী গুলিতে নিহত। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে হামলার পিছনে মাওবাদীরাই রয়েছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রবিবার রাত দেড়টা নাগাদ মেটালার জঙ্গলে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নিহত হলেন সিআরপি-র ১৮৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সহকারী সাব-ইনস্পেক্টর আর এন মহাকুণ্ড (৪৭) এবং কনস্টেবল এ বিজয়ভাস্কর রেড্ডি (২৬)। প্রথম জনের বাড়ি ওড়িশার বালেশ্বরে। আর নিহত কনস্টেবল অন্ধপ্রদেশের মেহবুবনগরের বাসিন্দা। জঙ্গলমহলে দু’জনেরই কর্মস্থল ছিল ঝাড়গ্রামের কদমকাননে ১৮৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সদর দফতরে।
ওই জঙ্গলে চলা ৪০ জন জওয়ানকে নিয়ে সিআরপি-র ছ’দিন ব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের সোমবার ছিল পঞ্চম দিন। সরকারি ভাবে সিআরপি এবং রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের দাবি, মাওবাদীদের অতর্কিত হামলায় ওই দু’জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনেরই একাংশের বক্তব্য, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে সতীর্থদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিতে গুলি চলে থাকতে পারে। সিআরপি-র শীর্ষকর্তারা অবশ্য সে কথা মানেননি। |
|
মেটালার জঙ্গল পরিদর্শনে সিআরপি-র আইজি বিবেক সহায়। —নিজস্ব চিত্র |
লালগড় আন্দোলন পর্বে মেটালার জঙ্গল মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। যাদের নেতৃত্বে ছিল মাওবাদীদের গণ মিলিশিয়ার তৎকালীন প্রধান সিদো সরেন ওরফে বটো বাস্কে। বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ও পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থানার সীমানা লাগোয়া এই এলাকা ছিল মাওবাদীদের ঘাঁটি। কাছেই ক্যানকেনালি গ্রামে মাওবাদী নেতা বিকাশ তথা সিংরাইল টুডুর বাড়ি। কিন্তু ২০১০-এর ২৬ জুলাই যৌথ বাহিনীর হাতে সিদো ও তাঁর পাঁচ সঙ্গী নিহত হওয়ার পর থেকে ক্রমশ মেটালা ও সংলগ্ন এলাকায় মাওবাদীদের প্রভাব যে ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিল, সেই ব্যাপারে তৃণমূল এবং সিপিএম দু’পক্ষই একমত।
কিন্তু রবিবার রাতের হামলা প্রসঙ্গে সিআরপি-র পক্ষ থেকে যে দাবি করা করা হয়েছে, সেটা সত্যি হলে মাওবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের শক্তি এবং এলাকায় তাদের সমর্থনের ভিত্তিদু’টি বিষয়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনকে উদ্বেগে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। আইজি (সিআরপি) বিবেক সহায় বলেন, “জনা দশেক মাওবাদী হামলা চালায়। এ কে-৪৭ কিংবা ইনস্যাস রাইফেলের মতো স্বয়ক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের দু’টি ম্যাগাজিন খালি করে দিয়েছে। ৪০ রাউন্ডের মতো গুলি চালিয়েছে তারা। জঙ্গলে বহু লোক কাঠ ও পাতা সংগ্রহ করতে ঢোকে। তাদেরই কেউ সম্ভবত আমাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের ব্যাপারে মাওবাদীদের খবর দিয়েছে।”
আইজি এ কথা বললেও প্রশ্ন উঠছে বেশ কিছু। প্রথমত, আইজি-র দাবি সত্যি বলে ধরে নিলে এটা স্পষ্ট যে, রাজ্য পুলিশ ও আধা সেনা মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে কোণঠাসা হয়েছে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কমে গিয়েছে বললেও ৪০টি গুলি খরচ করেছে মাওবাদীরা। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষ মারফত সিআরপি-র প্রশিক্ষণ শিবিরের খবর পাওয়ার অর্থ: মাওবাদীদের জন-সমর্থনের ভিত্তি এখনও কিছুটা অটুট। তৃতীয়ত, সিআরপি-র এই ধরনের ‘জাঙ্গল ক্যাম্প’-এর জন্য সাধারণত ‘নিরাপদ’ জায়গা বাছা হয়। কাজেই ওই এলাকা নির্বাচনই বুঝিয়ে দেয়, মেটালায় মাওবাদীদের সাম্প্রতিক শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে কোনও আগাম খবরই পুলিশ বা সিআরপি-র কাছে ছিল না।
মেটালা জঙ্গলের আশপাশে রয়েছে সিআরপি-র তিনটি ক্যাম্পবোড়োবাড়ি, কাদাশোল ও কাওয়াকোন। যৌথ বাহিনী নিয়মিত এলাকায় তল্লাশি অভিযানও চালায়। তবে কেন মাওবাদী হানার আভাস তাদের কাছে ছিল না, সেটাও প্রশ্ন। এ দিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আড়াইশো মিটার আগে আটকে দেওয়া হয়।
আইজি (সিআরপি) বলেন, “আক্রান্ত হয়ে আমাদের জওয়ানেরা ২২৯ রাউন্ড গুলি চালান। কিন্তু কিছু কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না।” মাওবাদীদের কোন স্কোয়াড হামলা চালিয়েছে? আইজি-র জবাব, “সেটা বলতে পারছি না।”
গোয়ালতোড়ের গা ঘেঁষা সারেঙ্গায় ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে গুলিতে নিহত হন সারেঙ্গা থানার তৎকালীন আইসি রবিলোচন মিত্র। সরকারি ভাবে মাওবাদীদের গুলিতে তাঁর নিহত হওয়ার কথা দাবি করা হলেও মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে এখনও।
মেটালার জঙ্গলের গা ঘেঁষা দু’টি পঞ্চায়েতজিরাপাড়া ও পাথরপাড়া। সেখানকার চৌরঙ্গি, দোবাটি, আমলাচটি, সুন্দরগেড়িয়া, চল্লাচাঙার মতো গ্রামগুলিতে এখন তৃণমূলেরই প্রভাব। দলের গোয়ালতোড় ব্লক সভাপতি রবি রায় বলেন, “ওখানে আমাদের সংগঠন খুবই মজবুত। তার মধ্যে মাওবাদীরা কী ভাবে এমন কাণ্ড ঘটাল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।”
আর মেটালার ঘটনায় আইজি-র মন্তব্য, “আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া একে আর কী বলব?” |
|
|
|
|
|