উইকেট এত সহজে দিতে নেই
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী অজ্ঞাতপরিচয় ক্যানসার রুগিদের মোবাইলে এখন হঠাৎ করে তাঁর ফোন আসে। কঠিন অসুখ সম্পর্কে সাধারণ ধ্যান-ধারণাকে প্রচণ্ড আক্রমণ করছে তাঁর ক্রিকেট মাঠের পারফরম্যান্স। রবিবার যেমন একটা ডিরেক্ট থ্রোয়ে রান আউট, অপরাজিত ১৯ রান এবং গুরুত্বপূর্ণ দু’টো উইকেটে আক্রমণ করেছিলেন পাকিস্তানি সম্ভাবনাকে! কলকাতায় ইদানীং কিছু আত্মহত্যার ঘটনার খবর পেয়েছেন। শুনেছেন, কঠিন রোগে আক্রান্ত মানুষ বাঁচার আশা ছেড়ে দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার মাঠে দাঁড়িয়ে আপাতত বিশ্বমঞ্চে এই সব নেতিমূলক চিন্তাকেই জয় করছেন। অনুপ্রেরণামূলক ‘৫ টিপস’ও তাই তিনি বাংলার সেই সব মানুষের উদ্দেশে দিচ্ছেন, যাঁরা জীবনযুদ্ধে ভেঙে পড়েছেন! সোমবার তাজ সমুদ্র হোটেলের ছ’তলায় নিজের ঘরে বসে যুবরাজ সিংহ বলছেন...
১) পজিটিভ থাকতে হবে: আমায় সে দিন এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল, খুব তো ইদানীং ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিস। বল তো, ব্যবসায় হঠাৎ ভরাডুবি হলে কী করব? মনে কর, সব টাকা-পয়সা রাতারাতি চলে গিয়েছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বিধ্বস্ত। আমি উত্তরে বলি, তা হলেও প্রথম মন্ত্র ওটাই। পজিটিভ থাকতে হবে ভীষণ ভাবে। পজিটিভিটি একটা দারুণ প্রতিষেধক। এমনকী, ক্যানসারেরও। আমি নিশ্চয় এত উন্মাদ নই যে বলব, মনকে পজিটিভ রাখলেই ক্যানসার সেরে যাবে! তা নয়। সারাবে ওষুধই। কিন্তু সেই ওষুধ তাড়াতাড়ি কাজ করবে, যদি আপনি পজিটিভ থাকেন! একই সঙ্গে স্বীকার করছি, স্পোর্টসম্যানদের পক্ষে এই পজিটিভ থাকাটা সাধারণ মানুষের চেয়ে সহজ। আমাদের জীবনটাই তো ছোটবেলা থেকে ওঠা-পড়ানির্ভ! কখনও দারুণ ভেসে উঠি। কখনও আবার জলে ডোবার মতো অবস্থা। দিনে ছ’ঘণ্টা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে শারীরিক কষ্টটা এমনিতেই অনেকটা গা-সওয়া হয়ে যায়। তার উপরে ওঠা-পড়ার ট্রেনিং নিয়মিত থাকলে ভাগ্যের মারে দুম করে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে মানাতে সুবিধে হয়।
২) বাস্তবে থাকুন, নিজেকে ঠকাবেন না: রিয়্যালিটি চেকটা ভীষণ জরুরি। আয়নার আপনাকে কিন্তু নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। আমার যখন ক্যানসার ধরা পড়ে, বাস্তবের সঙ্গে মানাতে দেরি করেছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, হো নেহি সকতা। ইয়ে মুঝে নেহি হ্যায়। ভুল হয়েছিল। রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি খাপ খাইয়ে নেবেন, তত ভাল। নিজেকে করুণা করার কিছু নেই। ভাবার কিছু নেই যে, ও তো দিব্যি আছে, ঈশ্বর আমাকেই কেন বাছলেন? এ সব ভেবে লাভ নেই। বরঞ্চ নিজেকে বলুন, ইয়েস, হয়েছে। এ বার এর সঙ্গে মরণপণ লড়ব। আর ধৈর্য দেখাব। রাতারাতি তো সেরে যাবে না! কিন্তু আমি সেই সময়টা দিতে রাজি আছি। পারলে তখন আপনাকে নিজের কোনও আইডল বা প্রিয় মানুষের কথা চিন্তা করে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, যিনি জীবনে কখনও লড়াই ছেড়ে দেননি।
৩) নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় রাখবেন: কঠিন রোগ বা দুঃসময়ের সঙ্গে যুরে দিনগুলোয় নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় বাঁচিয়ে রাখাটা খুব জরুরি। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, পড়ে থাকা জীবন থেকে আপনার চাহিদাটা কী? আমার যেমন চাহিদা ছিল, যেন-তেন-প্রকারেণ ভারতীয় দলে ফেরত আসা। নিজেকে বলতাম, মূল লক্ষ্য ওটাই। অতএব, রোগ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। যত শিগগির সম্ভব সুস্থ হতে হবে। নিজেই নিজের মনোবল-শিক্ষক হন। বুঝে নিন, কোন জিনিসটা করলে আপনার সবচেয়ে ভাল লাগছে। আপনি যদি কোনও পর্যায়ের পারফর্মার হন এবং উৎকর্ষকে তাড়া করে যাওয়াটা আপনার স্বভাবে থাকে, তো খুব ভাল! সেটা অসুখের পরেও অবিরাম করে যান। দেখবেন, রোগ থেকে মন সরে গিয়ে কত ভাল আছেন!
৪) প্রেরণা-তরঙ্গের খোঁজ করুন: বিভিন্ন পন্থা ট্রাই করুন। কোনটায় আপনার মন বেশি সাড়া দিচ্ছে? মিউজিক একটা রাস্তা হতে পারে। কিন্তু সব সময় নয়। আমি কেমো করার পরে একটা সময় মিউজিক চালালে মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করত! এতটুকু ভাল লাগত না। কারও যদি মনে হয় জীবন আর বাসযোগ্য নয়, তিনি ইউ টিউবে গিয়ে অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও-র খোঁজ করতে পারেন। হয়তো ওগুলো দেখলে জীবন সম্পর্কে ভাবনাটাই উল্টে যাবে। আমার ক্ষেত্রে অসম্ভব প্রেরণা জুগিয়েছিল বই। ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের বই। ক্যানসারের পরেও যে কী করে ত্যুর দ্য ফ্রান্স জিতেছিলেন! প্রার্থনা করতে শেখাটাও দারুণ মোটিভেটিং ব্যাপার। মন অসম্ভব নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৫) বন্ধু, পরিবার নিয়ে ঠিকঠাক সাপোর্ট গ্রুপ: এটা এমনি হয়ে গেল তো ভাল। না-হলে নিজেকে বুদ্ধি করে তৈরি করতে হবে। আপনার বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়দের নিয়ে। এই গ্রুপটার গুরুত্ব অসীম। আমার অভিজ্ঞতায় এদের ভূমিকা রুগির চেয়েও বেশি! রুগি তো সারাক্ষণ এদের সঙ্গেই থাকছে! এদের কাজ হল, একেবারে আহা-উহু না-করে রুগিকে পজিটিভ রাখা। এমন হাসিখুশি রাখা, যেন কিছুই হয়নি! আমার নিজের চারপাশে ২৪X৭ ছিলেন আমার মা। কিন্তু এ ছাড়াও থাকত অসাধারণ একটা বন্ধুদের দল। অনীশ গৌতম, মণীশ মলহোত্র (ডিজাইনার নয়), সন্দীপ শর্মা, নিশান্ত অরোরা, পারুল চাড্ডা, সঞ্জয় লাল। ওরা আমার সঙ্গে সারাক্ষণ এমন হাসিঠাট্টা চালিয়ে যেত, যেন কিছুই হয়নি! কেমোথেরাপির পরে আমেরিকায় হাসপাতালে শুয়ে থাকা অবস্থাতেও ওরা আমাকে ভাবতে দেয়নি যে, আমি কোনও কঠিন রোগে পড়েছি! তখন অর্ধেক সময় বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকত না। ওরাই ছিল আমার জানলা-দরজা। তা দিয়ে শুধু পজিটিভ সিগন্যালই আসত। ওদের হ্যা-হ্যা, হি-হি আর চ্যাংড়ামি দেখলে কে বুঝত যে, ওদের বন্ধু ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছে!
সব শেষে আমার জীবন থেকে একটা শিক্ষা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। তা হল: হাত-পা ছেড়ে দেওয়াটা তো এক সেকেন্ডের ব্যাপার। সবাই পারে। কোনও কৃতিত্ব নেই। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে কিছু যদি আপনার জীবনে অবশিষ্ট থাকে, হাল ছাড়বেন না। উইকেটটা এত সহজে দিতে নেই। আর যদি এক বার জীবনের দিকে পাল্টা গর্জন করার ইচ্ছেটা নিজের মধ্যে আনতে পারেন, দেখবেন, রোগকে জয় করা সম্ভব। দেখবেন, শুধু আমি নই, আরও অনেকে আশপাশে রয়েছে। দেখবেন দুরবস্থা বিজয়ীদের একটা লম্বা লাইন। নিজের জীবন কেড়ে নেওয়ার চেয়ে সেখানে দাঁড়ানোটা অনেক রোমাঞ্চকর।
যুবি-টোটকা
পজিটিভ থাকুন
নেতি-চিন্তা সরান। ওষুধ দ্রুত কাজ করবে।
রিয়্যালিটি চেক
নিজেকে করুণা নয়। বাস্তব মেনে লড়ুন।
আত্মবিশ্লেষণ
নিজেই বুঝুন, কী করলে ভাল লাগছে।
প্রেরণাসন্ধান
মিউজিক, ভিডিও, বই সর্বত্র রসদ খুঁজুন।
সাপোর্ট গ্রুপ
বাছাই করুন, কারা আপনাকে পজিটিভ রাখবে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.