শিক্ষাজগতে বিস্ময় শিক্ষাজগতে বিস্ময়
শিক্ষায় দলতন্ত্র রুখতে গলা চড়ল না কেন
রাজ্যের দীর্ঘদিনের ‘ঐতিহ্য’ বজায় রেখে শিক্ষায় শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার উদ্যোগে আইনি সিলমোহর লাগল কার্যত বিনা বাধায়। বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে উপাচার্য বাছাই, এমনকী বিভিন্ন বিভাগের ডিন বাছাইয়ের সার্চ কমিটিতে সরকার মনোনীত সদস্যের অনুপ্রবেশ ঘটানো হল। অথচ বিধানসভায় নিয়মরক্ষার কিছু বক্তব্য ছাড়া সিপিএম বা কংগ্রেস কোনও পক্ষেরই জোরালো প্রতিবাদ চোখে পড়ল না!
সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট শিক্ষাকে কার্যত আলিমুদ্দিনের মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিল বলে শিক্ষানুরাগীরা দীর্ঘকাল ধরে অভিযোগ করে এসেছেন। ফলে এখন বামেদের নরম প্রতিবাদে তাঁরা বিস্মিত নন। তবে তাঁদের অভিযোগ, কংগ্রেসও এই নিয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেনি। তা সে বাম আমলেই হোক বা বর্তমান তৃণমূল জমানায়।
আলিমুদ্দিনের পথেই তৃণমূলকে হাঁটতে দেখে শিক্ষা শিবিরে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিকতম সিদ্ধান্তের কারণ নিয়ে কাটাছেঁড়াও শুরু হয়েছে। শিক্ষাজগতের কেউ কেউ বলছেন, প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ-সহ রাজ্যের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করেছে বর্তমান সরকার। সার্চ কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি থাকলে এখন নিজেদের পছন্দের লোককে উপাচার্য করার ব্যাপারে তারা অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন বিভাগের ডিন কে হবেন, তা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে অন্দরের বিষয়। সেখানে রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করছে কেন?
শিক্ষানুরাগীদের কেউ কেউ এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূলের প্রভাব বিস্তৃত হলেও শিক্ষকদের মধ্যে তা হয়নি। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এবং ওয়েবকুটা-র নির্বাচনেও তার প্রমাণ মিলেছে। আর এত কাল ডিন বাছাই হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে। সেই পদ্ধতি এখনও মেনে চলতে গেলে বাম-অনুগামী শিক্ষকেরাই দায়িত্ব পেয়ে যেতে পারেন বলে সরকারি শিবিরের আশঙ্কা। সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নয় তারা!
তবে এ-সবই শাসক দল বা সরকারের ভাবনা। যা নিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের কোনও মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তাদের স্তিমিত প্রতিবাদ রাজনৈতিক শিবিরে বিস্ময় জাগিয়েছে। তবে কংগ্রেসের দাবি, বাম আমলেও তারা শিক্ষার রাজনীতিকরণের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এখনও তার ব্যতিক্রম হবে না। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, শিক্ষায় রাজনীতিকরণের প্রতিবাদ জানাতে বাম আমলে তাঁরাই পথে নেমেছিলেন। যার জেরে ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ তিন জন কংগ্রেসকর্মী নিহত হন। তার প্রতিবাদে সেই বছরের ৩ এপ্রিল বাংলা বন্ধও হয়েছিল।
আসলে পরিস্থিতি এমনই যে, বাম আমলে শিক্ষায় অনাচারের প্রতিবাদী আন্দোলনের কথা তুলে ধরতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকেও ৩১ বছর আগের নজির তুলে ধরতে হচ্ছে! বাম জমানায় প্রাথমিকে পাশ-ফেল বা ইংরেজি তুলে দেওয়ার মতো বিষয়েও কংগ্রেসকে সে-ভাবে প্রতিবাদে নামতে দেখা যায়নি। বরং সীমিত শক্তি নিয়েই প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছিল এসইউসি-কে।
তৃণমূলের জন্মের পর থেকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তির ব্যাটন চলে গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই। তখন কংগ্রেস মূলত আবদ্ধ ছিল নিয়মতন্ত্রে। কিন্তু এখন, পরিবর্তনের জমানায় এবং বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে তৃণমূলের সমর্থন প্রত্যাহারের পরে কংগ্রেসের সামনে নতুন সুযোগ এসেছে। যারা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি চাইছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করার এমন সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করছে কেন, উঠছে সেই প্রশ্ন।
তবে প্রদেশ সভাপতি প্রদীপবাবুর দাবি, “বিধানসভায় বৃহস্পতিবার যখন এই বিল আসে, আমাদের বিধায়ক অসিত মিত্র প্রতিবাদ জানান। এ বার বিধানসভার বাইরেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হবে।” কংগ্রেসের শিক্ষা সেলের প্রধান নির্মলেন্দু ভট্টাচার্য জানান, এই বিষয়ে কী করণীয়, তা ঠিক করতে তাঁরা ৪ অক্টোবর বৈঠকে বসবেন। প্রদেশ কর্মসমিতির ১২ অক্টোবরের বৈঠকেও এই বিষয়ে সবিস্তার আলোচনা হবে। কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সির যুক্তি, “বামফ্রন্ট শিক্ষা ক্ষেত্রে যে-ভাবে দলতন্ত্রকে কাজে লাগিয়েছিল, দলের বিশেষ ব্যক্তিদের বিভিন্ন জায়গায় স্থান দিয়েছিল, বিশেষত উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যা করেছিল, এখন তৃণমূলের সরকার সেই পথেই হাঁটছে।”
বিরোধী ভূমিকায় গিয়ে বাম শিবিরও প্রশ্ন তুলছে, যারা শিক্ষায় দলতন্ত্র দূর করার স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা আইনি পথে সেই দলতন্ত্রকেই বৈধতা দিল কেন? আলিমুদ্দিনের জমানায় শিক্ষায় ‘অনিলায়ন’-এর অভিযোগ বারংবার উঠেছে। কিন্তু বাম জমানায় এ ভাবে আইন করে সরকার তথা শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি বলে আলিমুদ্দিনের দাবি। তবে বাম জমানায় একই অভিযোগের এত ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে যে, বামেদের পক্ষে এই নিয়ে বিরাট প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে নৈতিক কিছু অসুবিধা আছে। যা কংগ্রেসের ছিল না বা নেই।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাই করেছি। এই বিল পাশ করানোর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে সরকারি হস্তক্ষেপের পথ খুলে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো বটেই, এমনকী ডিন নিয়োগেও এর পর থেকে সরকারের ভূমিকা থাকবে। দলতন্ত্রকেই আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হল।”
শাসক শিবির থেকে অবশ্য পাল্টা বক্তব্য রয়েছে যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে বামেদের কথা বলা সাজে না। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “কিন্তু রাজ্য সরকারের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তখন এমন আইনি বন্দোবস্ত করা হয়নি!”
বৃহস্পতিবার বিধানসভায় আইন সংশোধনের বিরোধিতা করে সংশোধনী জমা দিয়েছিলেন বাম বিধায়কেরা। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার বিল পাশ করিয়ে নেওয়ায় তাদের কিছু করার ছিল না বলে বামেদের বক্তব্য। বিলটি যখন বৃহস্পতিবার বিধানসভায় পাশ হচ্ছে, সেই সময় পঞ্চায়েতে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের প্রতিবাদ জানাতে ময়দানে সভা করছিলেন সূর্যবাবু-সহ বেশ কিছু সিপিএম বিধায়ক। তাঁরা বিধানসভায় থেকে আরও জোরালো প্রতিবাদ করতে পারতেন না?
সূর্যবাবুর ব্যাখ্যা, “কিছু করার ছিল না। এই সরকার এমনিতেই বিরোধীদের মুলতুবি প্রস্তাব বা সংশোধনী কিছুই মানে না। বৃহস্পতিবার এমন ভাবে কর্মসূচি ছিল যে, আমাদের সকলের পক্ষে ওই সময় বিধানসভায় থাকা সম্ভব হয়নি।” বামফ্রন্টের তরফে বিধানসভায় বিলের বিরোধিতা করেছিলেন প্রাক্তন পরিষদীয় মন্ত্রী তথা ডিএসপি-র বিধায়ক প্রবোধ সিংহ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.