বোর্ড প্রধানকে মুখের ওপর বলা, নির্বাচনী বৈঠকে আপনি কী করছেন? বা ধোনিকে ০-৮ হারের পর ভারত অধিনায়কত্ব থেকে সরাতে চেয়ে তোড়ফোড় করা। মোহিন্দর অমরনাথের মাঠের বাইরে হাতে ব্যাটবিহীন অসম সাহসিকতার কাহিনিতে এখন গমগম করছে ভারতীয় ক্রিকেটের অলিন্দ!
প্রেমদাসায় শুক্রবারের জবরদস্ত দু’টো ডার্বি ম্যাচ। রুদ্ধশ্বাস ক্রিকেট আর উত্তেজনা মিশে পাকিস্তানের শেষ ওভারে রোমাঞ্চকর জয়! ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ভেঙে পড়া। আর অস্ট্রেলিয়ার দুরন্ত পারফরম্যান্স। অথচ পাশাপাশি চব্বিশ ঘণ্টা পুরনো হেডলাইনটা সেই দপদপ করে জ্বলেই রইল!
একই দিনে বহিষ্কার ভারতীয় ক্রিকেটের দুই কামব্যাক সম্রাটের।
প্রথম জন অবশ্যই মোহিন্দর। যাঁকে নির্বাচক হিসেবে ছাঁটাই করা নিয়ে গোটা দেশের ক্রিকেট ও মিডিয়া মহল উত্তাল।
অন্য জন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভকেও যে কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে গত কালের প্রবল মোহিন্দর হ্যাংওভারে কেউ সে ভাবে ধরতে পারেনি। টিভির নিউজ চ্যানেল দূরে থাক। আনন্দবাজার ছাড়া কোনও কাগজ ফলাও করে তাঁর অপসারণের কাহিনি ছাপেনি। সৌরভ নিজেই তো শুক্রবার রাতেও কিছুটা সংশয়ে। অন্তরালে ঠিক কী ঘটে গিয়েছে?
তাজ সমুদ্র-র ব্রেকফাস্ট টেবিলে লক্ষ করা গেল অস্ট্রেলিয়ার জন্য তৈরি হওয়ার সঙ্গেই এই দু’টো ঘটনারও প্রত্যক্ষ বিশ্লেষণ চলছে। সেই বিশ্লেষণের উপসংহার হল, বোর্ডের নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছ কী মরেছ। ওরা ইয়েসম্যান চায়। একটা বিরুদ্ধ কথাও বরদাস্ত করবে না। তা যার কাছ থেকেই আসুক!
মোহিন্দর অবশ্য পদচ্যূত হয়েও বিশাল নৈতিক সমর্থন পাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেটমহলে। ধোনি বিরোধী শিবিরের অন্তত সাত জন তাঁর পাশে। সামনে এসে বলার প্রশ্নই নেই। ভারতের হয়ে খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। কারও কারও মনে হচ্ছে, সিনেমাজগতে যেমন আকছার হয়, এক জনের কথা ভেবে স্ক্রিপ্ট লেখা হল। আর এক জন তাতে অভিনয় করল তেমনই যেন ঘটনাটা মোহিন্দরের জীবনে এসে হাজির হল।
আজহারউদ্দিন তখন অমিত ক্ষমতাশালী ভারত অধিনায়ক। রবি শাস্ত্রীকে বোর্ড প্রস্তাব দিল কোচ হওয়ার। শাস্ত্রী বললেন, ক্ষমতার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তাঁর কিছু শর্ত রয়েছে। যেগুলো মঞ্জুর হলেই দায়িত্ব নেবেন। তখন শাস্ত্রীকে পরিচিত ক্রিকেটারবন্ধুরা বলেছিলেন, বোর্ড যা-ই কথা দিক, আজহার কিন্তু মানবেন না। ওর সঙ্গে লড়তে গিয়ে বরং মুখ কালো করে বেইজ্জত হয়ে চলে যেতে হবে আপনাকে। ছেলেদের সামনে সেটা সম্মানের হবে না।
শাস্ত্রী তখন অবিচলিত ভাবে বলেছিলেন, “ছেলেরা এটুকু জানলেই যথেষ্ট হবে যে লোকটাকে কেন চলে যেতে হল!” মোহিন্দরের বেলা যেন অবিকল তাই ঘটল। বেশ কিছু ক্রিকেটার মুগ্ধ গলায় বলল, “জিমি পাজিকে ওরা সরিয়ে দিল ঠিকই। কিন্তু এ রকম বলিষ্ঠ মানুষকেই আমাদের দরকার।”
অমরনাথকে বাঁচাতে খুব আগ্রহী ছিলেন অরুণ জেটলি। জেটলি বোর্ডে যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাঁর ছোটখাটো চাওয়া না চাওয়া বোর্ডে এক রকম আইন। কিন্তু অমরনাথের বেলা জেটলির কথাও শুনতে রাজি হননি এন শ্রীনিবাসন। সিনিয়র নির্বাচক কমিটিতে তিনি অবাধ্য কাউকে নেবেন না।
অমরনাথের ‘অপরাধে’র কথা শুনতে গিয়ে সাম্প্রতিক অতীতের চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা বার হয়ে পড়ল। চেন্নাইয়ের শেরাটন হোটেলে দল নির্বাচনী সভা চলছিল। সেখানে অমরনাথ এত উদাত্ত অথচ কঠোর রূপে দেখা দেবেন কেউ দুঃস্বপ্নেও দেখেনি। তিনি খুব দ্রুত শ্রীকান্তকে বলে দেন, ০-৮ হারার পর ধোনিকে নিউজিল্যান্ড সিরিজে ক্যাপ্টেন রাখার কোনও মানে হয় না। গৌতম গম্ভীরকে নতুন নেতা বেছে ফেলো। মুহূর্তের মধ্যে পূর্বাঞ্চলের রাজা বেঙ্কট-সহ দুই নির্বাচক বলে দেন, তাঁরাও একমত। অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেখানে মুখ্য নির্বাচক শ্রীকান্ত দেখেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ধোনি নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলছেন। তখন তিনি নিমেষে ফোন করেন শ্রীনিবাসনকে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলেন, সভা মুলতবি করে রাখো। আমি নিজে আসছি। সভা চলছিল চেন্নাইয়ের আইটিসি শেরাটনে। মিনিট কুড়ির মধ্যে প্রেসিডেন্ট পৌঁছে যান সেখানে। মোহিন্দর তখনও উত্তেজিত সওয়াল করে যাচ্ছেন গম্ভীরকে কেন বাছা উচিত। এই সময় শ্রীনিবাসন সভার মধ্যে ঢুকে পড়ে জানিয়ে দেন, অধিনায়ক বদলানো যাবে না। এতে বোর্ডের সায় নেই।
মোহিন্দর তখন প্রচণ্ড চটে গিয়ে বলেন, টিম গড়ার দায়িত্ব তো আমাদের। আমাদের সেই কাজটা করতে দিন না। আপনি এখানে আমাদের বৈঠকে কী করছেন?
শ্রীনিবাসন তৈরি ছিলেন। সভায় এসেছিলেন, বোর্ডের সংবিধান হাতে নিয়েই। আইনের সেই বইটা এ বার ছুড়ে টেবিলের ওপর ফেলে দেন তিনি। বলেন, মিস্টার অমরনাথ দয়া করে দেখে নিন নিয়মটা। আপনাদের তৈরি দল বা অধিনায়ক নির্বাচন কোনওটাই নিরঙ্কুশ নয়। দেশে এবং বিদেশে দুটোতেই প্রেসিডেন্টের অনুমোদনসূচক সই দরকার। আপনারা গম্ভীর যদি ঠিকও করেন, আমি সই না করা পর্যন্ত সেই নির্বাচন বেকার।
এর পর সভার গতিপথ আবার ক্যাপ্টেন অপরিবর্তিত রাখার স্রোতেই ফেরত যায়। আর মোহিন্দর-শ্রীনিবাসনের গতিপথও যেন চূড়ান্ত ভিন্নমুখ হয়ে যায়। জনশ্রুতি হল, আপনি এখানে কী করছেন কথাটা অত্যন্ত আপত্তিজনক মনে করেছেন বোর্ড প্রধান আর তাই জেটলির মধ্যস্থতাতেও বরফ গলল না।
ও দিকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন প্রেমদাসায় বসে বললেন, “আমার মনে হয় আমাকে সরাবার কারণ আমি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলা ছাড়িনি বলে। ওরা টেকনিক্যাল কমিটিতে এমন কাউকে নেবে না যে পুরোপুরি রিটায়ার্ড নয়। রাহুলকেও সে জন্য রাখেনি।” কিন্তু আপনাকে তো বোর্ড অপসারণের কথাও জানায়নি। যেটা স্বাভাবিক সৌজন্য। বা এমনও বলেনি যে, আমাদের জানাও এ বছর ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলবে কি না? খেললে আর রাখব না।
সৌরভ বললেন, “হ্যাঁ। সেটা ঠিক জানায়নি যে। জানানোটা বোধহয় উচিত ছিল।”
বোর্ডের অন্দরমহলে খবর হল, সৌরভের টেকনিক্যাল কমিটির শীর্ষ পদ থেকে অপসারণে কেউ বিস্মিত নন। বোর্ড নানা ব্যাপারে তাঁর ওপর বিরক্ত ছিল। বিরক্তির অন্যতম কারণ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ খেলতে চেয়ে দু’বার লিখিত আবেদন করা। বোর্ডকর্তারা বিদেশে টি-টোয়েন্টি খেলার অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে ভীষণ ভীষণ স্পর্শকাতর। আজ অবধি কাউকে যেতে অনুমতি দেননি। সৌরভ কেন বোর্ডের সেন্টিমেন্ট বুঝলেন না এটা তাঁদের কাছে প্রখর বিরক্তির কারণ।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলবেন কি খেলবেন না সেটাও আজ অবধি নিশ্চিত করে নাকি বোর্ডক
মোহিন্দরের মতো অবশ্য সৌরভও ইতিমধ্যে টের পেয়েছেন, পদ হারিয়ে ক্রিকেটমহলের অখণ্ড সম্মান জিতছেন। এঁরা দু’জন সত্যিটা বলার সাহস দেখিয়েছিল!
|
৫ অপরাধ |
যে চার্জশিট না দিয়েই বরখাস্ত |
মোহিন্দর অমরনাথ |
১) কিছুতেই বোর্ডের ইয়েসম্যান হতে না চাওয়া।
২) ধোনিকে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরানোর দুঃসাহসী প্রয়াস নিয়ে দুই নির্বাচককেও প্রভাবিত করে ফেলা।
৩) নির্বাচনী বৈঠকে ঢুকে আসা শ্রীনিবাসনকে প্রশ্ন করা, আপনি এই সভায় কেন?
৪) উত্তরাঞ্চলের ছোট ম্যাচ থেকে উঠতি ক্রিকেটারদের পাদপ্রদীপের আলোয় আনার চেষ্টা না করা।
৫) অরুণ জেটলির মধ্যস্থতার পরেও নানা ব্যাপারে ভারতীয় বোর্ড সম্পর্কে চূড়ান্ত অনমনীয় মনোভাব দেখানো। |
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় |
১) কিছুতেই বোর্ডের ইয়েসম্যান না হতে চাওয়া।
২) হালফিল ধোনি ও শ্রীকান্তের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় প্রচণ্ড সরব হওয়া।
৩) মোহিন্দরের মতো মানুষকে নির্বাচক কমিটিতে রেখে দেওয়া উচিত প্রকাশ্যে বলা।
৪) বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের মতো বোর্ডকর্তাদের অপছন্দের টুর্নামেন্ট খেলতে চেয়ে লিখিত আবেদন করা।
৫) প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে কবে অবসর নিচ্ছেন পরিষ্কার না বলা। |
|