দূষণ নিয়ন্ত্রণে কলকাতা এগোতে পারুক বা না-পারুক, পুজোর থিম হিসেবে ‘দূষণ’ বা ‘পরিবেশ’ বেশ জনপ্রিয়। শহরের অনেকগুলো বড় পুজোয় এ বছরেও থিম পরিবেশ দূষণ। তাতে শহরের মানুষের কাছে দূষণ নিয়ন্ত্রণের বার্তা কতটুকু পৌঁছেছে, সে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই গিয়েছে। এরই মধ্যে ব্যতিক্রম পূর্ব-কলকাতায় একটি ‘সৌর-মণ্ডপ’। সেখানে সৌর প্যানেল থেকে যে বিদ্যুৎ তৈরি হবে, তা থেকেই আলো পাবে পুজো।
পনেরো বছরের পুরনো অবৈধ বাস, লরি, ট্যাক্সির ধোঁয়া আর অবৈধ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের অবাধ ব্যবহারের কলকাতায় দুর্গা পুজোর এই থিম যেন শহরটাকেই ঠাট্টা করছে। যাঁরা মূলত পুজোর মাধ্যমে দূষণ নিয়ন্ত্রণের বার্তা ছড়াতে চান, তাঁদের অনেকেই নানা মাপের জন-প্রতিনিধি। কিন্তু ওই পুজে মণ্ডপের বাইরে তাঁদের পরিবেশ চেতনার কোনও কার্যকর প্রচেষ্টার ছাপ দেখতে পায়নি শহর।
গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার দূষণ নিয়ন্ত্রণকে থিম করে বড় বাজেটের পুজো করছে সুরুচি সঙ্ঘ। গত বছর তাঁদের বিষয় ছিল বৃষ্টির জল ধরে, তার ব্যবহার। এই বছর তাঁদের বিষয় গোয়ার সমুদ্রের দূষণ। সেই সূত্রে তাঁদের মণ্ডপ সেজেছে কোঙ্কনি আর পর্তুগিজ শিল্পের ধারায়। নানা ধরনের ঝিনুক, শামুক, শঙ্খ ব্যবহার করে শিল্পের নিখুঁত রূপায়ণে আর রঙের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো মণ্ডপে দূষণের গ্লানির কোনও ছোঁয়া পর্যন্ত নেই।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, আয়লার পরে ওই বছর পুজোয় পর্ষদের পক্ষ থেকে সমস্ত পুজো কমিটির কাছে সুন্দরবনের দুর্যোগ-বিধ্বস্ত মানুষদের সাহায্য করার আবেদন জানানো হয়। পর্ষদের ‘নির্মল পুজো’ প্রতিযোগিতায় যাঁরা অংশ নেন, তাঁদের কাছেও এই আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু কলকাতার একটি মাত্র পুজো কমিটি কিছু সাহায্য পাঠিয়েছিল। ফলে থিম হিসেবে ‘পরিবেশ দূষণ’-এ বিশ্বাস হারিয়েছেন বিশ্বজিৎবাবু। তাঁর কথায়, “পরিবেশ বা দূষণ থিম করে কোনও লাভই হয় না, যদি তা প্রয়োগের জায়গায় না পৌঁছতে পারে।”
ইদানীং নানা প্রতিযোগিতায় সেরা পুজো নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পরিবেশকেও একটা মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। এখন অনেকেই তাই পুজোকে পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা করেন। তবে সে তো স্রেফ সেরার শিরোপা পাওয়ার জন্য। গত কয়েক বছর ধরে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ‘নির্মল পুজো’ প্রতিযোগিতাও শুরু করেছে। সব মিলিয়ে পুজোর মধ্যে দিয়ে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা মহড়া থাকে নিশ্চয়। কিন্তু বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন নেই। সুরুচি সঙ্ঘের কর্ণধার তথা রাজ্যের যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অবশ্য বললেন, “পুজোর মধ্যে দিয়ে আমরা একটা বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছি। এখনই হয়তো তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তবে এক দিন মানুষ সচেতন হবে।”
অথচ দুর্গা পুজোয় স্রেফ আলো জ্বালিয়ে বিপুল পরিমাণ কার্বন তৈরি হয়। প্রত্যেকটা পুজোর জন্য গড়ে দিনে ২৫ থেকে ৩০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। আর কয়লা পুড়িয়ে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে হয় এক কেজি দুশো গ্রাম কার্বন। সেই কার্বন প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে। পুজোর সময়ে কেবল কলকাতা শহরেই প্রায় দেড়শো মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ হয়। গোটা রাজ্যে ওই খরচের পরিমাণ আড়াইশো মেগাওয়াট। অথচ চেষ্টা করলেই পুজোয় প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অন্তত কিছুটা সৌর সেল বসিয়ে তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। তাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে খানিক সাহায্য করতে পারতেন পুজোর উদ্যোক্তারা। সে পথে অবশ্য কেউই হাঁটেন না। তবে সুরুচি সঙ্ঘ এ বছর বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এলইডি ল্যাম্প ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে অন্তত ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে বলে জানালেন অরূপবাবু। বালিগঞ্জে ত্রিধারা সম্মিলনীর পুজোতেও এ বার আলোকসজ্জা এলইডি ল্যাম্পে। ওই পুজোর কর্ণধার পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার বললেন, “পুজোয় দূষণ নিয়ন্ত্রণের বার্তা দিয়ে হয়তো অনেক কিছু করে ফেলা যায়নি, তবে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে।”
শহরে একমাত্র ব্যতিক্রম বাইপাসের পূর্ব পাড়ে কালিকাপুরে পাড়ার পুজো ‘মহাতীর্থ সিটিজেন্স ফোরাম’। সেখানে গোটা পুজোটাই সৌর শক্তি নির্ভর। লোহার কাঠামোর পুজো মণ্ডপের পুরোটাই ঢেকে দেওয়া হয়েছে সৌর প্যানেলে। সেখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ২৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। সেই বিদ্যুতে এলইডি-র শক্তিসাশ্রয়ী আলো জ্বলবে মণ্ডপে এবং চারপাশের রাস্তায়। পুজো কমিটির সভাপতি এবং সৌরশক্তি প্রসার আন্দোলনের পুরোধা শান্তিপদ গণচৌধুরী জানালেন, মণ্ডপ নির্মাণের জন্য লোহার কাঠামো কেনা হয়েছে পুরনো লোহা-লক্করের দোকান থেকে। পুজোর পরে ওই লোহা আবার কালোয়ারদের কাছেই বিক্রি করে দেওয়া হবে। মণ্ডপটি অগ্নি প্রতিরোধকও বটে। এ ছাড়া, পুজোর দর্শনার্থীদের জন্য বসানো হচ্ছে পরিবেশসম্মত বায়ো-টয়লেটও।
সৌর আলোর মতো সেটাও কলকাতায় এ বার প্রথম। |