পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব সম্পূর্ণ। ‘অনিলায়ন’-এর পর এ বার ‘মমতায়ন’। এ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে কঠিন মুষ্টিতে কুক্ষিগত করিয়া লইল মমতায়নের শৃঙ্খল। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগে রাজ্য সরকারের ভূমিকায় সিলমোহর পড়িল। এখন হইতে উপাচার্য বাছাইয়ের অনুসন্ধান কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যের জায়গায় থাকিবেন রাজ্য সরকারের মনোনীত বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ এই বাছাইয়ের পদ্ধতিতে সরাসরি রাজ্য সরকারের শৃঙ্খল বহাল হইবে। এই শৃঙ্খলের প্রকৃতি ও প্রয়োজনীয়তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝাইয়া দিয়াছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। পরিবর্তনের ধ্বজাধারী মন্ত্রী ও তাঁহার নেত্রী সর্বসমক্ষে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন, এত দিন ধরিয়া শিক্ষা-সংক্রান্ত তাঁহাদের যত গুরুগম্ভীর প্রতিশ্রুতি, সবই সর্বৈব অসার, অসত্য। তাঁহাদের বহুবিজ্ঞাপিত পরিবর্তন আসলে স্থিতাবস্থারই অন্য নাম। অনিলায়নের নব অবতার মমতায়ন।
এই নূতন অবতার অবশ্য কেবলই পুনরাবৃত্তি বলিলে ভুল হইবে। কার্যক্ষেত্রে দুইয়েরই সারমর্ম এক। দুইই সরকারি কর্তৃত্বের মোড়কে দলতন্ত্রের দৃপ্ত নির্লজ্জ কার্যক্রম, বিদ্যোৎকর্ষ কিংবা শিক্ষা-অভিজ্ঞতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে শিক্ষক কিংবা উপাচার্য নিয়োগের প্রকরণ। তবে বাহ্যিক অবয়বে ইহাদের মধ্যে পার্থক্যও আছে। ‘অনিলায়ন’-এর কার্যক্রম একটি সংহত দলীয় দর্শনের ভিত্তিতে রচিত, স্পষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত। দলীয় দর্শন বলিয়া কেহ তাহাকে হেয়জ্ঞান করিতে পারেন, দলীয় স্বার্থ-সন্ধান বলিয়া সমালোচনা করিতে পারেন, কিন্তু এ কথা না মানিয়া উপায় নাই যে, প্রমোদ দাশগুপ্ত হইতে অনিল বিশ্বাস, সি পি আই এম নেতারা কিন্তু এই সামাজিক শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নীতিতে ব্যক্তিগত ভাবে ও দলগত ভাবে আমূল বিশ্বাসী। তাঁহারা যাহা করিয়াছেন, বিশ্বাসের শক্ত জমির উপর দাঁড়াইয়া করিয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তেমন কথা বলা শক্ত। শিক্ষার তৃণমূলীকরণ কোনও আদর্শ বা বিশ্বাস হইতে উদ্যত নহে, আর সম্ভবত সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপন নির্বাচনী রাজনীতির পাওনা-গণ্ডা হিসাব এবং ক্ষমতাপ্রতিষ্ঠার স্বার্থটি প্রকাশ্যে স্বীকার করিতে নারাজ। তাই এক দিকে প্রাক্-নির্বাচনী কাল হইতে এ যাবৎ সরকারি প্রচারে বারংবার উঠিয়া আসিয়াছে বর্তমান সরকার কী ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর হইতে কর্তৃত্ব সরাইয়া তাহাকে নিরপেক্ষতার বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাদ আনিয়া দিবে, কী ভাবে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও সরকারি কমিটির অঙ্গুলিতর্জনের গণ্ডি পার হইয়া যাইবে, এই সব অলীক প্রতিশ্রুতি আর অন্য দিকে, ক্ষমতা-প্রাপ্তির প্রথম লগ্ন হইতে চলিতেছে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলতন্ত্রের অহিংস কিংবা সহিংস দাপট। সাম্প্রতিক উপাচার্য-সংক্রান্ত ঘোষণা কোনও ব্যতিক্রম নহে, কেবল সেই অবিচ্ছিন্ন ধারায় শেষতম সংযোজন-মাত্র। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষা জগৎ এত দিন মৃতপ্রায় ছিল, এই সরকারের আমলে তাহা কফিনবদ্ধ হইল, কফিনে পেরেক পোঁতাও শেষ হইল।
উপাচার্য নিয়োগের পদ্ধতিটি যে এত দিনই যথার্থ ছিল, এখনই বিভ্রান্ত হইতেছে, এমন কথা বলিলে ভুল হইবে। এই কমিটিতে ইউ জি সি সদস্যরা এত দিন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে অবস্থান করিতেন। কিন্তু প্রয়োজন ছিল এই পদ্ধতি পাল্টাইয়া, কেন্দ্রীয় সদস্যদের বাদ দিয়া, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে বাহিরে ঠেলিয়া, সারস্বত প্রতিনিধিদের কমিটি গড়িয়া উপাচার্য নির্বাচন। তাহাই হইত প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। যে পরিবর্তন শিক্ষার যথার্থ মুক্তি আনে। তাহা হইল না। পরিবর্তন হইল। কিন্তু অভিমুখের বদলে কেবল রং পাল্টাইল। সরকার থাকিল। কেবল সরকারের পরিচয় পাল্টাইল। সাড়ম্বরে সিলমোহর পরাইয়া, মমতায়ন আসিয়া অনিলায়নকে লইয়া গেল। |