বাঁশ-কাপড়ের একটা মঞ্চ, বড়সড় ব্যানার, মাইক্রোফোন-চোঙা আর সাকুল্যে জনা পনেরো লোক। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। শহরের প্রাণকেন্দ্র, খাস ধর্মতলায় জনজীবন স্তব্ধ করে রাজনীতি জমিয়ে তুলতে কার্যত আর বিশেষ কিছুর দরকার নেই।
বৃহস্পতিবার দুপুরে অবশ্য কয়েক হাজার লোক শহরের পথে নেমেছিলেন। একসঙ্গে মেট্রো চ্যানেল, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ ও মেয়ো রোডে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে তিন-তিনটি সমাবেশের জেরে যানবাহনের নড়াচড়াই সারা দিনের জন্য থমকে যায়। শুক্রবারও পথ আটকে সভার জেরে ভুগতে হয় শহরবাসীকে। একটি রাজনৈতিক মিছিল এ দিন রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হয়েছিল।
এ সব কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতাবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, জাঁদরেল রাজনৈতিক শিবির থেকে উটকো সংগঠন, পরিচিত বিশিষ্টজন থেকে নামগোত্রহীন উগ্র প্রতিবাদী যে কেউ যখন-তখন চাইলেই এ ভাবে পথের দখল নিতে পারেন। রাজ্যের বিরোধী শিবির থেকে শাসকপক্ষ, এ বিষয়ে কারও ছিটেফোঁটা ভ্রূক্ষেপও নেই। ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে সপ্তাহের কাজের দিনে বিভিন্ন কমর্সূচিতে তাই উপস্থিত থাকতে দেখা যায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। এ রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও রাজপথ দখল করে রাজনীতিতে যে বদলের নামগন্ধ নেই, তা মানছেন পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাই। লালবাজার সূত্রের খবর, চলতি মাসেই প্রায় এক দিন অন্তর কোনও না কোনও ছোট-বড় সভার জেরে অবরুদ্ধ হতে হয়েছে ধর্মতলা-চত্বরকে। |
অথচ, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বন্ধের রাজনীতি বন্ধ করার মতো কাজের দিনে শহরে সভা আয়োজনেরও যে তিনি পক্ষপাতী নন, তা জানিয়েছিলেন খোদ মমতাই। ২১ জুলাইয়ের মতো বছরের কয়েকটি বিশেষ দিন বাদ দিলে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও চেয়েছিলেন, ছুটির দিন ছাড়া শহরের ব্যস্ত এলাকায় মিটিং-মিছিলের পাট একেবারে উঠেই যাক।
সেই মমতাই গত সোমবার একটি সভায় নৈতিক সমর্থন জানাতে আগাগোড়া উপস্থিত থেকেছেন। বৃহস্পতিবার বামফ্রন্টের নেতারাও যেমন সামিল হয়েছিলেন মেয়ো রোডে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে।
জওহরলাল নেহরু রোড ও লেনিন সরণির সংযোগে মেট্রো চ্যানেল ছাড়া এস এন ব্যানার্জি রোডের মুখে ডোরিনা ক্রসিং, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ এবং ডোরিনা ক্রসিং ও এসপ্ল্যানেড ইস্টের মধ্যবর্তী অংশেই (ওয়াই রোড) সাধারণত সভা-সমাবেশ বসে। লালবাজারের কর্তারা মানছেন, এর কোনও একটিতে সভার জেরেও যান চলাচল মসৃণ রাখায় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বৃহস্পতিবারের কলকাতায় একসঙ্গে এই সব ক’টি জায়গাই সভা-সমাবেশের জেরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ফলে ভোগান্তির বহরটাও অনেক গুণ বেড়ে যায়। শুধু সভাই নয়, সভার আগে সাধারণত সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে ধর্মতলামুখী মিছিল বা সভা শেষে ফিরতি পথে জনতার ঢলও নিত্যযাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে হামেশাই।
এ সবই লালবাজারের কর্তাদের জানা। তবু দিনের পর দিন রাজনৈতিক ‘চাপে’র সামনে কেন এ ভাবে মাথা নোয়ায় পুলিশ? কেন এসপ্লানেড ইস্টের মতো সভা-সমাবেশ বন্ধ হয় না মেট্রো চ্যানেল, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়েও?
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিমের সাফাই, পথ আটকে সভার ক্ষেত্রে পুলিশ কিন্তু কাউকেই সরাসরি অনুমতি দেয় না। তবে কেউ সভার ব্যাপারে আগাম জানালে পুলিশ তাদের আবেদনপত্র গ্রহণ করে। একটি নির্দিষ্ট তারিখে কোনও কর্মসূচি ঠিক করা থাকলে ওই জায়গায় সভা করার জন্য দ্বিতীয় কারও আবেদনপত্রই নেয় না পুলিশ। সেই সঙ্গে সভা-সমাবেশের নামে রাজপথের দখলদারদের প্রতি ‘পরোক্ষ সমর্থনে’র সুরেই শামিমের মন্তব্য, “গণতান্ত্রিক দেশে কেউ জোর করে বসে পড়লে আর কী করা যাবে! পুলিশ তো লাঠিচার্জ করে তুলে দিতে পারে না। তবে জোর করে বসলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।” কিন্তু রাস্তা দখল করার জন্য মামলা রুজু করার নজির যে দুর্লভ, তা-ও মানছেন ওই পুলিশকর্তারা।
অর্থ পরিষ্কার, আপাতত এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তির পথ নেই। |