ফিরছেন গ্যালিলিও গ্যালিলেই।
আশির দশকের গোড়ায় কলকাতায় এসেছিলেন ফ্রিৎস বেনেভিৎস। সাবেক পূর্ব জার্মানির ওয়েইমার ন্যাশনাল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক তিনি। ফ্রিৎসের পরিচালনায় শহরের তাবড় মঞ্চব্যক্তিত্বেরা একসঙ্গে মিলে অভিনয় করেছিলেন বের্টোল্ট ব্রেশট-এর নাটক ‘গ্যালিলিওর জীবন’। নাম ভূমিকায় ছিলেন শম্ভু মিত্র।
একই সময়ে ‘গ্যালিলিও’-র অভিনয় শুরু করে বহুরূপীও। সে প্রযোজনায় নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন কুমার রায়। হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘গ্যালিলিও’ মঞ্চস্থ হয়েছিল এ সবেরও আগে। তারও আগে ষাটের দশকে ‘গ্যালিলিও’-র অনুবাদ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক।
১২ অক্টোবর থেকে কলকাতার মঞ্চে আবার আসছে ‘গ্যালিলিও’। এ বার যিনি ‘গ্যালিলিও’কে মঞ্চে আনছেন, তাঁরও নাট্যচর্চার একটা বড় অধ্যায় খাস জার্মানিতেই অতিবাহিত। তিনি অঞ্জন দত্ত।
নাটকের অনুবাদও অঞ্জনেরই। কবিতাগুলো গান হয়ে গিয়েছে। ব্রেশটেরই অন্যান্য নাটকের গানের সুর তাতে লাগিয়েছেন নীল দত্ত। অঞ্জনের কথায়, “মূল নাটকটা কোথাও বদলাইনি। শুধু এখনকার চোখ দিয়ে দেখছি মাত্র।” কলকাতা এর আগে যে ক’টি ‘গ্যালিলিও’ দেখেছে, তার চেয়ে এর মেজাজটা আলাদা। “প্রশাসন আর ব্যক্তির সংঘাতই এখানে বড়। চিন্তা ও সংস্কৃতি কী ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার নাগাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে, সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে।” |
নাটকের মহড়ার একটি দৃশ্যে। —নিজস্ব চিত্র |
মাঝের দু’দশক মঞ্চ থেকে সরে ছিলেন। বাংলা নাট্যজগতের সঙ্গে অঞ্জনের সম্পর্কও কোনও দিনই মসৃণ নয়। তা হলে এত দিন পর আবার মঞ্চে কেন? “পরপর ছবি করতে করতে হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে খানিকটা ভাঙচুর করা দরকার ছিল।” তা ছাড়া এই সময়টাও আগের চেয়ে খানিকটা অনুকূল বলে মনে হয়েছে তাঁর। “আজ যখন নাটক করব ঠিক করলাম, কৌশিক-সুমন-চন্দন-দেবেশ-ব্রাত্যরা সবাই উৎসাহ দিল। নানা ভাবে সাহায্য করল। এটা আগে পাইনি তেমন।”
শেষ সত্তর থেকে আশির দশক জুড়ে যে সময়টা অঞ্জনরা নাটক করতেন, দু’এক জন বাদে বাংলার নাট্য মহল তাঁদের ‘পাকা, বখাটে’ বলেই মনে করত। ১৯৮০ সালে গোলমালের জেরে আকাডেমিতে ‘মারাত/সাদ’ নাটকের অভিনয় বন্ধই করে দিতে হয়েছিল। তার পর থেকে আর কখনও আকাডেমিতে ডেট পাননি অঞ্জন। ১৯৮২-তে চলে গেলেন জার্মানি। তখনকার পশ্চিম বালিনে ‘থিয়েতুর ম্যানুফ্যাক্তুর’ নামে একটি নাট্যসংস্থায় কাজ করলেন টানা দু’বছর। সীমান্তের কাছেই ছিল জায়গাটা। মাঝে মাঝে গিয়ে ব্রেশট-এর নিজের দল ‘বার্লিনার অনসম্বল’-এর অভিনয় দেখে আসতেন। ব্রেশট-এর জামাতা তখন অভিনয় করতেন ওখানে। তার পর দেশে ফিরেও নাটকের কাজ যে ভাবে করতে চেয়েছিলেন, হয়নি। সুতরাং সিনেমায় বেশি মন দিতেই হল। কমবেশি নাটক তা-ও চালিয়ে গেলেন আরও বছর আষ্টেক। ১৯৯২-এর পর আর হয়নি।
১৯৭৮ থেকে ১৯৯২, বাংলা নাটকের মূল ধারায় কোনও দিনই ধরা হয়নি অঞ্জনদের ‘ওপেন থিয়েটার’কে। অঞ্জনের সঙ্গী সে সময় রাজা সেন, শেখর দাস, মিতালি ভট্টাচার্য, মিলন রায়চৌধুরীরা। কলকাতার নাট্য মহলের সঙ্গে সেতুবন্ধনটা হল না কেন? তার একটা বড় কারণ, অঞ্জন নিজেই বলছেন, গ্রুপ থিয়েটারের চলতি কাঠামো, দলীয় শাসন-বারণের আবহটা তিনি কোনও দিন মানতে পারেননি। এখন অবস্থার কিছুটা বদল হয়েছে। অঞ্জনের সঙ্গে এই নাটকে কাজ করছেন নানা দলের ছেলেমেয়েরাই। আছেন শঙ্কর চক্রবর্তী, নীল মুখোপাধ্যায়রাও।
অথচ এই অঞ্জনই এক সময় বাদল সরকারকে নিয়ে ‘কিং লিয়ার’ করতে চেয়েছিলেন। হয়নি। “লোকে বলেছিল, অভিনেতার চেয়ে পরিচালকের বয়স কম, এটা হয় না।’’ আজ কিন্তু হয়! “হয় বলেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজ সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনাতে লিয়ার করছেন!” অঞ্জনও আবার নাটক করার উৎসাহ পাচ্ছেন! কিন্তু বাণিজ্যিক ভাবে নাটকের প্রযোজনা এখানে কতটুকু হয়? “হয় যে না, সেটাই তো সমস্যা।” অঞ্জন সরাসরি বলছেন, “নতুন প্রজন্মের প্রযোজকরা যদি কোটি টাকা খরচ করে ছবি করতে পারেন, নাটকের জন্য তিন লাখ টাকা দিতে পারবেন না?” তাতে নাট্যচর্চায় ‘স্বাধীনতা’র জায়গাটা ক্ষুণ্ণ হবে না? অঞ্জন সেই ভয় আঁকড়ে বসে থাকার পক্ষপাতী নন। “জনপ্রিয়তার শর্ত
মেনে নিজের কথা বলতে পারাটাই শিল্পীর চ্যালেঞ্জ। শেক্সপিয়র এবং ব্রেশট, দুজনেই তার মস্ত উদাহরণ।”
সেই টানেই ব্রেশট-এ ফেরা। কলকাতায় ফেরা ‘গ্যালিলিও’-রও। |