পাশ বিল
উপাচার্য বাছাইয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে সিলমোহর
বাম জমানার দলতন্ত্র থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করে ‘পুনরুজ্জীবন’ ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নতুন সরকার। কিন্তু শেষমেশ শিক্ষায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটল তারাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাছাইয়ের জন্য গড়া সার্চ কমিটিতে এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মনোনীত সদস্যের জায়গায় থাকবেন রাজ্য সরকারের মনোনীত বিশেষজ্ঞ। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় এই সংক্রান্ত বিল পাশ হয়েছে। শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই বন্দোবস্ত আসলে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায় সরকারি হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করবে। সরকার-মনোনীত সদস্যের মতামত কমিটির অন্য সদস্যদের প্রভাবিত করতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও এ দিন বিধানসভায় পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, “উপাচার্য কে হবেন, সে ব্যাপারে সরকারেরও বক্তব্য থাকা উচিত বলে মনে করি। তাই এই পরিবর্তন করা হল।” তবে পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, সার্চ কমিটিতে ইউজিসি-র মনোনীত সদস্য পেতে দেরি হচ্ছিল। এই সিদ্ধান্তের সেটিও অন্যতম কারণ। যদিও তৃণমূলের ভিতরের খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই পরিবর্তন চেয়েছেন।
বাম জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে ছোট-বড় প্রায় সব সিদ্ধান্তই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ইশারায় নেওয়া হত বলে অভিযোগ ছিল। এমনকী, উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারেও অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য যোগ্যতার তুলনায় দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য পেত বলে অভিযোগ। সেনেট-সিন্ডিকেট-কাউন্সিলে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মোড়কে আসলে দলতন্ত্র কায়েম হয়েছিল বলে বিশিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে আক্ষেপ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট বা কোর্ট উপাচার্য পদে তিন জনের নাম প্রস্তাব করে পাঠাত আচার্য-রাজ্যপালের কাছে। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে আচার্য ওই তিন জনের মধ্যে এক জনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করতেন। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আলিমুদ্দিনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই নির্ণায়ক হয়ে উঠত।

সুনন্দ সান্যাল: এরা সিপিএমের
থেকেও নগ্ন ভাবে
দলতন্ত্র শুরু করেছে।

অনুপ সিংহ: মনে হচ্ছে,
ক্ষমতা অপব্যবহারের
পথ খোলা হল।

স্বপন চক্রবর্তী: এরা তো
নিজেদের কথা থেকেই
পিছিয়ে আসছে!
বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই তৃণমূল এই ‘অনিলায়নে’র বিরুদ্ধে সরব ছিল। ক্ষমতায় এসেই নয়া সরকার তাই বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে উপাচার্য নিয়োগের সাবেক পদ্ধতিতে বদল আনে। নতুন আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দল বা সরকারের কোনও ভূমিকা রাখা হয়নি। সেখানে বলা হয়, আচার্য তথা রাজ্যপাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট বা কোর্ট এবং ইউজিসি-র মনোনীত তিন জন সদস্য নিয়ে সার্চ কমিটি হবে। কমিটি উপাচার্য পদের জন্য তিনটি নাম প্রস্তাব করে পাঠাবেন আচার্যের কাছে। আচার্য সেই তালিকা থেকে এক জনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন। এই নিয়ম মেনে কলকাতা, যাদবপুর ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগও হয়েছে।
তবে শিক্ষা দফতরের একটি সূত্রের খবর, রবীন্দ্রভারতীতে সার্চ কমিটির বাছাইয়ের ক্রম রাজ্য সরকারের পছন্দ হয়নি। যাদবপুরের ক্ষেত্রেও সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নামের সঙ্গে রাজ্য সরকার একমত হতে পারেনি। সরকার নিযুক্ত সদস্য কমিটিতে থাকলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হত না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে উপাচার্য বাছাইয়ে সরকারের পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্ন উঠছে কেন? সেখানে সরকারের ভূমিকার আদৌ প্রয়োজন কী? এর বিশদ ব্যাখ্যা অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী দেননি। বিধানসভার অধিবেশন চলাকালীন এ দিন বামফ্রন্টের প্রবোধ সিংহ প্রশ্ন করেন, গত ডিসেম্বরে পাশ করা আইন থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এই পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন কী ছিল? জবাবে শিক্ষামন্ত্রী জানান, আগের বাম সরকার নিজেদের পাশ করানো শিক্ষা আইনে মোট ৫০ বার সংশোধনী এনেছিল। তা-ও এক বছরে কয়েক বার।
কিন্তু এতে কি শিক্ষাক্ষেত্রে ফের দলতন্ত্র কায়েমের পথই প্রশস্ত হচ্ছে না? বিধানসভার বাইরে ব্রাত্যবাবু বলেন, “আমরা দল ও সরকারকে আলাদা ভাবে দেখছি।” মন্ত্রীর কথায়, জাতীয় স্তরে সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, এমন ব্যক্তিদেরই মনোনীত করা হবে। তিনি রাজ্যের বাইরেও থাকতে পারেন। “তবে রাজ্যের লোককে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমরা বাঙালি বিশেষজ্ঞদের মনোনীত করার চেষ্টা করব।” বিশিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তাঁদের বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদেরই সার্চ কমিটিতে রাখা উচিত। সেখানে বাঙালি-অবাঙালি ভেদ করতে যাওয়াটা অবান্তর।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্চ কমিটিতে ইউজিসি-র মনোনীত সদস্য ছিলেন ইতিহাসবিদ মুশিরুল হাসান, যাদবপুরে ছিলেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দকৃষ্ণন এবং রবীন্দ্রভারতীতে ছিলেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার উপাচার্য নাজিব জঙ্গ। বাঙালি না হলেও নিজেদের ক্ষেত্রে এঁরা প্রত্যেকেই কৃতী। আর দেরিতে নাম পাঠানোর ব্যাপারে মন্ত্রী এ দিন যে অভিযোগ করেছেন, সংশ্লিষ্ট তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র কিন্তু তা নাকচ করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, কোনও সদস্যের নাম পাঠাতেই খুব বেশি সময় নেয়নি ইউজিসি। বরং দু’-একটি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত সদস্যের নাম আসতেই দেরি হয়েছিল বলে তাঁদের দাবি।
সার্চ কমিটিতে বদলের পাশাপাশি এ দিনের বিলে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন বাছাইয়েও এখন সার্চ কমিটি তৈরি করা হবে। সেই কমিটিতে থাকবেন, এক জন উপাচার্য (যাঁকে আচার্য মনোনীত করবেন), রাজ্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত সদস্যেরা। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উপাচার্য ডিন নিয়োগ করবেন। ডিনের কার্যকাল হবে তিন বছর। এ ছাড়া ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল, স্নাতক সংসদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব সংস্থা পরীক্ষা নেওয়া, ফল প্রকাশ ইত্যাদি গোপনীয় কাজ করে, সেগুলি থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়া হয়েছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.