শস্য-সন্তান চেয়ে করমে, ইঁদে মাতল ঝাড়গ্রাম
স্যের আকাঙ্খায় প্রকৃতির উপাসনা এক বহু পুরোনো প্রথা। নানা জনজাতির মধ্যেই নানা রূপে, নানা বিশ্বাসে এই প্রথা চলে আসছে। এভাবেই শস্যের সমৃদ্ধি ও সন্তান কামনায় প্রতি শরৎকালেই করম উৎসবে মেতে ওঠেন জঙ্গলমহলের মূল বাসিন্দারা। তাঁদের বিশ্বাস, করম ঠাকুরের কৃপায় মাঠ-জমি উপচে ফসল আসবে। আর এই বিশ্বাসে ভর করেই ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীর সন্ধ্যায় কুমারী ও এয়োতিদের দেওয়া নৈবেদ্যে ‘করম ঠাকুর’-এর পুজো করেন লায়া (পূজারি)।
পঞ্জিকা মতে এ বার পার্শ্ব একাদশী ছিল বুধবার। রীতি অনুযায়ী করম গাছের পুজো করে সেই ডাল ভেঙে শোভাযাত্রা করে বাড়ির আঙিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সমবেত করমগীতির সুরের আবহে ওই করম গাছের ডাল বাড়ির আঙিনায় পোঁতেন লায়া।
জঙ্গলমহলের গ্রামগঞ্জে কুড়মি-সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মূল বাসিন্দারায় মূলত এই উৎসবে যোগ দেন। ঝাড়গ্রাম শহরের একমাত্র সার্বজনীন করম পুজোটি হয় শহরের মধুবনে। এবার সেই পুজোর ২৭ বছর। ১৯৮৫ সালে শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কালীপদ মাহাতোর পৃষ্ঠপোষকতায় ওই পুজো শুরু হয়। বর্তমানে পুজোর ‘মোড়ল’ (হোতা) কালীপদবাবুর পৌত্র রাজকুমার মাহাতো। রাজকুমারবাবু জানান, চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী, মঙ্গলবার দশমী তিথিতে স্থানীয় একটি করম গাছকে পুজো করে ‘জাগানো’ হয়। বুধবার সন্ধ্যায় ওই গাছের ডাল কেটে ঢোল-মাদল বাজিয়ে পূজাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়। পুজোর দায়িত্ব পালন করেন ‘লায়া’ ভবতারণ মাহাতো। রাজকুমারবাবু বলেন, “জঙ্গলমহলের অশান্তি কারণে বিগত কয়েক বছর নিয়ম রক্ষার পুজো হয়েছিল। এবার অবশ্য বেশ ধূমধাম হচ্ছে।” রাতে ‘পাঁতা নাচ’-এর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ঝুমুর গান পরিবেশিত হয়।
ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
আজ বৃহস্পতিবার, প্রকৃতি উপাসনার আরেক রকমফেরও দেখা যাবে ঝাড়গ্রামে। সেটি হল গাছগড় ঝাড়গ্রামের রাজাদের ‘ইন্দ্রাভিষেক’ বা ইঁদ পুজো। এই পুজোয় ছাল-বাকল ছাড়ানো আস্ত একটি শাল গাছের বল্লি লাগে। ওই শাল বল্লিকেই ইন্দ্ররূপে পুজো করা হয়। করম পুজোর পরদিন দ্বাদশী তিথির মধ্যরাতে এই উৎসব হয়। জনশ্রুতি আছে, কয়েক’শো বছর আগে গড় ঝাড়গ্রামের স্থানীয় জংলি মাল রাজাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করে রাজ্যপাট দখল করেন রাজপুতানার সর্বেশ্বর সিংহ। তিনিই ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজ বংশের আদিপুরুষ। সর্বেশ্বরের রাজ্যাভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই এই উৎসবের সূচনা। বহু আগে প্রত্যেক বছর এই দিনটিতে প্রজা ও করদ-জোতদারদের উপঢৌকন গ্রহণ করার জন্য ‘অভিষেক মঞ্চে’ আসীন হতেন মল্লদেব রাজারা। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতে, “রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানটিতে পরবর্তীকালে ইন্দ্রের দেবত্ব আরোপিত হয়ে ‘ইন্দ্রাভিষেক’ হয়েছে।” তিনি জানান, আগে ঝাড়গ্রামে ইঁদের বড় মেলা হতো। এখন অবশ্য সেই অর্থে মেলা আর হয় না। তবে গ্রামাঞ্চলে অবশ্য বিভিন্ন এলাকায় এখনও হাতেগোনা কয়েকটি ইঁদের মেলা হয়।
করম পুজোর তিনদিন আগে ইঁদের জন্য বন দফতরের বিশেষ অনুমতি নিয়ে জঙ্গল থেকে শালগাছ সংগ্রহ করা হয়। এবার গত রবিবার জঙ্গল থেকে একটি শালগাছ কাটার পর আস্ত গুঁড়িটি নিয়ে আসা হয়েছিল ইঁদকুড়ি ময়দানে। তারপর প্রথা অনুযায়ী, সোমবার ছিল ‘বিশ্রাম’। মঙ্গলবারের দিনটি ‘চাঁছাছোলা’। অর্থাৎ শাল গাছের গুঁড়িটির ছালবাকল চেঁছে লম্বা ও মোটা শালবল্লিটি তৈরি করা হয়। সেটিকে বলা হয় ‘ইঁদকাঠ’। বুধবার করম পুজোর দিনে শাল বল্লিটিকে ‘আধাগাছি’, অর্থাৎ হেলিয়ে কৌনিক ভাবে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইন্দ্রপুজোর পরে হেলিয়ে রাখা বল্লিটি দড়ি ধরে টেনে সোজা করে তোলা হবে।
দড়িতে প্রথম টান দেবেন মল্লদেব রাজ পরিবারের উত্তরসূরি শিবেন্দ্রবিজয় মল্লদেব। তারপর দড়িতে টান দেবেন ব্রাহ্মণ পূজারী। সবশেষে বিজিত মাল রাজার এক উত্তরসূরি এবং সর্বসাধারণ দড়ি ধরে টান দিয়ে ‘ইঁদকাঠ’টি তুলবেন। সুব্রতবাবু বলেন, “ইঁদকাঠটি তোলার এই অনুষ্ঠানের মধ্যে নিহিত রয়েছে রাজার ক্ষাত্রতেজ প্রতিষ্ঠার দাবি।” সাত দিন পরে স্থানীয় সাবিত্রী পুকুরে ‘ইঁদকাঠ’ বিসর্জন দেওয়া হয়। ইঁদ তোলার রাতে ঝুমুর ও লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান হয়। ইঁদপুজোর দিনে ভাল ফসলের আকাঙ্ক্ষায় মূলবাসীরা ইন্দ্রদেবের সন্তুষ্টির জন্য ধানজমিতে ‘পড়াশি ঝাঁটি’ নামে এক ধরনের গাছের ডাল পোঁতেন। কেউ কেউ আবার শাল গাছের ডালও পোঁতেন। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘ডালগাড়া’।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.