ছদ্মবেশে কিছু গলদ ছিল। তাই ধরা পড়তে দেরি হচ্ছিল না। পড়তাতেও পোষাচ্ছিল না। অগত্যা বাজার থেকে কার্যত পাট উঠিয়েছিল জাল একশো টাকার নোট। দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল মূলত পাঁচশো আর হাজার।
কিন্তু ইদানীং ইতি-উতি ফের জাল একশোর হদিশ মেলায় প্রমাদ গুনছে পুলিশ। এ দফায় জালিয়াতেরা ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেকটা শুধরে ফেলায় গোয়েন্দারা আরও চিন্তিত। তাদের দাবি, একশোর জাল নোট নিয়ন্ত্রিত সংখ্যায় ঢুকলেও আমজনতার বিপদ বাড়বে। “লোকে ধরে নিয়েছে, একশোর নোট জাল হয় না। তাই বান্ডিলে পাঁচ-দশটা জাল মেশানো সহজ।” বলেন সিআইডি-র এডিজি বাণীব্রত বসু। গোয়েন্দামহলের একাংশের কথায়, এ যেন নতুন চেহারায় পুরনো বিপদের প্রত্যাবর্তন।
বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে জাল একশোর প্রত্যাবর্তন ঘটল সাড়ে চার-পাঁচ বছর বাদে। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: ২০০৪-এ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে এক চক্রের ডেরায় শ’পাঁচেক জাল একশোর নোট পেয়েছিল পুলিশ। ২০০৭-এ উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরে মিলেছিল হাজার দেড়েক। তার পরে গত চার বছরে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫ কোটি টাকার যে সব নকল নোট ধরা পড়েছে, তার সিংহভাগই পাঁচশো ও হাজারের। কিন্তু গত বছর থেকে তালিকায় ফের একশোর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। তার বহরও ঊর্ধ্বমুখী। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর হাতে গত বছর ১৫টি একশোর জাল নোট এসেছিল। এ বছর ন’মাসেই সংখ্যাটা চল্লিশ!
গোয়েন্দা-কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা: পাঁচশো-হাজারি নোটে লাগাতার নজরদারি চলায় জালিয়াতরা এখন একশোর দিকেও ঝুঁকেছে। এবং ‘সুরক্ষার স্বার্থে’ তারা ব্যবহার করছে উন্নততর প্রযুক্তি। এসটিএফের এক অফিসার বলেন, “এ দেশে এক সময়ে মান্ধাতার প্রযুক্তিতে ছাপা জাল নোট অজ গাঁয়ের হাটে-বাজারেও ধরা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত দু’বছরে পাওয়া একশোর জাল নোটগুলোর খুঁত সাদা চোখে ধরা মুশকিল। সম্ভবত দক্ষ প্রিন্টিং টেকনোলজিস্টরা এতে যুক্ত।” চক্রের হাতে অত ভাল মানের কাগজ ও উপযুক্ত কালি কী ভাবে পৌঁছে গেল, তা ভেবেও উদ্বিগ্ন গোয়েন্দারা। |
অতএব, পুলিশ বিষয়টিকে ‘হিমশৈলের চূড়া’ হিসেবে দেখছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাল নোট সংক্রান্ত রাজ্যস্তরের সমন্বয় কমিটির বৈঠকে লালবাজারের গোয়েন্দারা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, পাঁচশো-হাজারের পাশাপাশি ‘জাল একশোর বিপদ’কেও তাদের জন-সচেতনতা কর্মসূচিতে ঢোকানো হয়েছে মাস তিনেক আগে। এগুলোর উৎস কোথায়?
গোয়েন্দাদের দাবি: পাঁচশো-হাজারের জাল নোটের সিংহভাগ বিদেশে ছাপা হলেও ‘প্রায় নিখুঁত’ একশোর নকল নোট ছাপা হচ্ছে এ দেশেই। এ ক্ষেত্রে সঙ্কট গভীরতর, কেননা কারবারিদের সীমান্ত পেরোনোর ঝুঁকিও নিতে হচ্ছে না। সিআইডি-কর্তাদের যুক্তি, বিদেশে একশোর নোট ছাপালে চক্রের খরচায় পোষাবে না, কারণ বিস্তর সংখ্যায় ছাপতে হবে। কিছু গোয়েন্দা-অফিসার এ-ও জানিয়েছেন, নতুন একশোর জাল নোটগুলো ‘প্রায় নিখুঁত’ হলেও তার মান বিদেশে ছাপা পাঁচশো-হাজারির তুলনায় একটু খারাপ।
তবে দেশের মধ্যে ঠিক কোথায় তা ছাপা হচ্ছে, সে সম্পর্কে পুলিশ এখনও অন্ধকারে। কারণ, একশোর জাল নোট সমেত এ যাত্রায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। এসটিএফ’কে সব ক’টা নোটই পাঠিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। উল্লেখ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী দেশে জাল টাকার ৭০ শতাংশই ঢুকছে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে। আর গোয়েন্দামহলের অনুমান, যত জাল নোট ধরা পড়ছে, তার অন্তত দশ গুণ ছড়িয়ে গিয়েছে বাজারে!
এ অবস্থায় ‘ত্রুটিমুক্ত’ একশোর প্রত্যাবর্তনে সমস্যা আরও ঘোরালো হবে বলেই পুলিশের আশঙ্কা। |