এ যেন লটারি! পেতে পারেন, না-ও পারেন। পেলে ভাল। আর না পেলে?
তখন নিজেই নিজের সহায় হওয়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু পরিস্থিতি যখন অনেক ক্ষেত্রে জীবন-মরণের হয়ে দাঁড়াতে পারে, তখন লটারির মতো পাওয়া না-পাওয়ার অনিশ্চয়তা থাকবে কেন, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
উঠছেও। সাম্প্রতিক কালে কলকাতায় পুলিশি সাহায্যের জন্য ‘১০০’ নম্বরে ফোন করার একাধিক ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতাই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। আম-নাগরিকের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে যে আপৎকালীন (ইমার্জেন্সি) নম্বরটি ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা। ওই নম্বরে বিপদ-বার্তা গেলেই ‘মুশকিল-আসান’ পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যাবে বলে প্রশাসনিক প্রচারেও খামতি নেই। অথচ পুলিশ ‘হাজির হওয়া’ দূর, সঙ্কটের সময়ে একশোর ফোনে সাড়াই মিলছে না বলে হামেশা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
যেমন ফের পাওয়া গিয়েছে রবিবার। চেতলায় এক অটোচালকের হাতে নিগ্রহের অভিযোগ জানাতে নিজের মোবাইল থেকে ‘১০০’ নম্বরে ফোন করেছিলেন প্রবীরবরণ সরকার। কলকাতা পুলিশের ওই অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের দাবি, তিনি কোনও শব্দ শুনতে পাননি, লাইনও হঠাৎ কেটে যায়। ক’দিন আগে কসবার গৃহবধূ নন্দিতা বসুরও প্রায় একই অভিজ্ঞতা। “গাড়িতে উল্টোডাঙার দিকে যাচ্ছিলাম। ইএম বাইপাসের অম্বেডকর ব্রিজের কাছে দেখি, এক জন জখম হয়ে পড়ে আছে। আমি, আমার স্বামী ও মেয়ে তিন জনে নিজের নিজের মোবাইল থেকে একাধিক বার ১০০ ডায়াল করি। কেউ কোনও শব্দ শুনতে পাইনি।” বলছেন নন্দিতাদেবী।
|
১০০-র ফোন ধরেন কারা? ব্যবস্থাটাই বা কী রকম?
লালবাজার-সূত্রের খবর: ইমার্জেন্সি নম্বরের দশটা লাইন। প্রতিটা লাইনে আসা কল ধরতে প্রতি শিফ্টে ১০ জন কনস্টেবল থাকেন। কম্পিউটারের সামনে কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে থাকেন তাঁরা। বাইরের কল স্বয়ংক্রিয় ভাবে যাঁর লাইনে ঢোকে, তিনি ফোন তোলেন। ১০০ নম্বর ‘ব্যস্ত’ থাকার অর্থ, দশটা লাইনই এক সঙ্গে ব্যস্ত। যদিও এমন ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে বলে পুলিশের দাবি।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, কলকাতার মতো বড় শহরে আপৎকালে পুলিশ ডাকার জন্য মাত্র দশটা লাইন কেন? তা ছাড়া লাইন ব্যস্ত থাকলেও এ ধরনের পরিষেবার ক্ষেত্রে ‘কল ব্যাক’ (অর্থাৎ যে নম্বর থেকে ফোন গিয়েছিল, সেখানে পুলিশের তরফে ফোন) করা হবে না কেন?
প্রথম প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে
লালবাজারের বক্তব্য: কল-ব্যাকের ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। ফলে বিপন্ন কেউ ১০০ নম্বরে ফোন করে ‘বিজি’ পেয়ে যদি ছেড়েও দেন, পরে পুলিশ চাইলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। কিন্তু ব্যবস্থাটি কেন রাখা হয়নি, তার স্পষ্ট উত্তর মেলেনি পুলিশ-কর্তাদের মুখে।
গলদ অবশ্য আরও রয়েছে। পুলিশ-সূত্রের খবর: অনেক সময়ে শহরের সীমানাবর্তী থানা-এলাকা থেকে ১০০ নম্বরে ফোন করলে কল চলে যাচ্ছে নিকটবর্তী জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে! যেমন, বছরখানেক আগে উল্টোডাঙার বিধান নিবাস আবাসনে ডাকাতির পরে এক বাসিন্দা ১০০-য় ডায়াল করেছিলেন। তাঁর ফোন চলে গিয়েছিল মধ্যমগ্রামের দোলতলায় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের কন্ট্রোলে। ফলে কাজের কাজ কিছু হয়নি।
লালবাজারের কর্তাদের একাংশের মতে, সার্ভার কখনও-সখনও গোলমাল করে বলেই এমন সব বিপত্তি হয়ে থাকে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিমও সোমবার বলেন, ‘‘একশো ডায়ালে মাঝে-মধ্যে প্রযুক্তিগত সমস্যা হয়।” কী রকম?
পুলিশের এক সূত্রের দাবি: টেলিকম সংস্থাগুলোর পরিষেবাতেই সমস্যা। তাই সব ফোন কন্ট্রোল রুমে ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না। লালবাজারের খবর, ১০০ ডায়ালের টেলি-সংযোগের দায়িত্বে রয়েছে বিএসএনএল। অন্য কোনও টেলিকম সংস্থার নম্বর থেকে আসা কলও বিএসএনএল মারফত পুলিশ কন্ট্রোলে আসে। বিএসএনএল-কর্তৃপক্ষ কী বলেন?
বিএসএনএলের একটি মহলের পাল্টা অভিযোগ, এ ধরনের জরুরি পরিষেবা ব্যবহার করার জন্য যে মানের পরিকাঠামো দরকার, লালবাজারের তা নেই। এক বিএসএনএল-কর্তার কথায়, “পরিকাঠামোয় খামতির দরুণ প্রতি ঘণ্টায় নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি কল ওই নম্বরে ঢোকে না। তাই সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই ইমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করে সাড়া
পান না।” এ প্রসঙ্গে রেলের টোল-ফ্রি হেল্পলাইন নম্বরের (১৩৯) কথা বলছেন বিএসএনএল-কর্তাদের একাংশ। সংস্থার চিফ জেনারেল ম্যানেজার সোমনাথ দাস জানিয়েছেন, ১৩৯ ও ১০০ দু’টো নম্বরের প্রযুক্তি এক। ১৩৯ ‘সাফল্যের’ সঙ্গে কাজ করলেও ১০০ নিয়ে অভিযোগ উঠছে কেন, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। “ঠিক কোন কোন এলাকা থেকে ফোন করলে সমস্যা হচ্ছে, সেটা ধরতে পারলে ত্রুটি বোঝা সহজ হবে।” বলেন সোমনাথবাবু।
১০০ ডায়াল ব্যবস্থা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে যারা, সেই কেরালা স্টেট ইলেকট্রনিক্স ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (কেলট্রন)-এর এক কর্তা জানিয়েছেন, লালবাজার কন্ট্রোলে এখন গড়ে দৈনিক ছ’হাজার ফোন আসে। এক সঙ্গে তিরিশটি কল ঢোকার সুযোগ থাকলেও স্রেফ কর্মীর অভাবে এক সঙ্গে দশটার বেশি কল নেওয়া যাচ্ছে না। তাই অনেকে লাইন ব্যস্ত পাচ্ছেন। কিন্তু সার্ভার বসে যায় কেন?
কেলট্রন কনসালটেন্সি সার্ভিসেসের জেনারেল ম্যানেজার আর প্রদীপের ব্যাখ্যা, “১০০ ডায়ালের ফোন রেকর্ড করা হয়। সেই তথ্য সার্ভারে পাঠানোর সময়ে কখনও সার্ভার ডাউন হয়ে যায়।” বস্তুত এই ব্যবস্থায় সার্ভার বসে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা বলে ওঁদের দাবি। এবং ওঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, সমস্যাটির আশু কোনও সুরাহা নেই।
ভিন্ দেশেও তো পুলিশের আপৎকালীন নম্বর রয়েছে। সেখানে কী হয়?
কলকাতা পুলিশের এক অফিসার বলছিলেন, “আমার ছেলে আমেরিকায় থাকার সময়ে এক
বার ফ্ল্যাটের ভিতরে বেকায়দায় আটকে পড়েছিল। তড়িঘড়ি ও ইমার্জেন্সি পুলিশ নম্বরে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখে, পুলিশ-দমকল
এসে হাজির!”
এ শহরে অবশ্য ১০০ ডায়ালে সাড়া মিললেই অনেক। সাহায্য পরের কথা।
|