যেন বজ্রাঘাতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সারা গ্রামই। আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার অভিসম্পাত দিচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু রবিবারের নির্মেঘ আকাশে শনিবারের বজ্রপাতের রেশটুকুও ছিল না। ঝকঝকে সেই আকাশের হাসি মুখ আরও বিষাদে ঢেকে দিচ্ছিল দফরপুরকে।
শনিবার গ্রামের ৫ ছেলে মাঠে খেলার সময়ে বজ্রপাতে মারা যায়। আচমকা সেই খবর শুনে কেউ বিশ্বাস করতে চাননি, এমনটাও হতে পারে। মোবারকের মা মলদা বিবি এই দিন ছেলের দেহের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্তনাদ করছিলেন, “ফুটবলকে বড় ভালবাসত ছেলেটা।”
শুধু এই কথাটাই যেন শোকবজ্র হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল গ্রাম জুড়ে। এরা তো সবাই ফুটবলকে ভালবাসত। বলের পিছনে ছুটত। শট নিয়ে হেসে উঠত। প্রাণখোলা আনন্দে মেতে থাকত সারাটা বিকেল। তাদের হালি চিৎকারে অভ্যস্ত ছিলেন গ্রামের মানুষ। মলদা বিবি তারপরেই বললেন, “দুপুর হলেই ছুটে যেত প্রতিদিন মাঠের দিকে। কোনওদিন বাধা দিইনি।” যেন প্রতিধ্বনি হয়েই ফিরে আসে প্রশ্নকেন বাধা দাওনি? মলদা বিবি তারই উত্তরে বুক চাপড়ে বলে ওঠেন, “ওই দিন আকাশ ভারি হয়েছিল। আমার মন মানছিল না। যেতে দিতে চাইনি। একটু পরেই ফিরে আসবে বলে চলে গিয়েছিল।”
রবিবার সকালে ময়নাতদন্তের পরে মৃতদেহগুলি দফরপুরের বাড়িতে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে গোটা গ্রামের মানুষ। পাশেই বাড়ি আরমান শেখের। তিনি বলেন, “বড্ড মিশুকে স্বভাবের ছেলে ছিল মোবারক। দুই ছেলের ছোট বলে বাবা লাল্টুর ন্যাওটা ছিল সে। ফুটবল অন্ত প্রাণ। বাড়িতে কাজ না থাকায় মাঠে গিয়েছিলাম আমিও। বৃষ্টি জোর না থাকলেও মেঘের গর্জন ছিন প্রচণ্ড। বিদ্যুতের ঝলসানি, মেঘের কড় কড় শব্দে একসময় ভয় পেয়ে খেলা বন্ধ করে যে যার মতো ছুটে গিয়েছিল মাঠ লাগোয়া মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের স্কুল ভবনে। কেউ আবার ছুটেছিল বাগানের বিশাল আমগাছের নীচে। নিমেষেই আলোর ঝলকানি, আর প্রচণ্ড শব্দ। কে যে কোথায় ছিটকে পড়ল, বোঝাই গেলনা। আমি ছিলাম গাছের নীচে দাঁড় করানো একটা রিক্সা ভ্যানের উপর বসে। ছিটকে পড়লাম আমিও। হঠাৎ দেখি ডান হাত জ্বলে যাচ্ছে, ডান কানে শুনতে পাচ্ছি না। কী করব ভাবতে ভাবতেই মিনিট কয়েক কেটে গেল। ইতিমধ্যেই ছুটে এল কয়েকজন যুবক। তড়িঘড়ি তারাই ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে গেল আহতদের। ততক্ষণে অবশ্য মারা গিয়েছে চার জন।” পরে হাসপাতালে মারা যায় আরও এক জন।
দফরপুরের মল্লিকপাড়ায় একটু এগিয়েই জসিমুদ্দিলের বাড়ি। বাবা জহিরুল শেখ পেশায় রাজমিস্ত্রী। টালির বাড়িতে কাল সন্ধ্যা থেকেই হাঁড়ি চড়েনি। জহিরুল বাকরুদ্ধ। বাড়ির সামনের বাগানো ভিড় জমিয়েছে পাড়ার লোক। সেখানেই ময়না তদন্তের পরে এনে রাখা হয়েছিল জসীমুদ্দিনের দেহ। মসজিদপাড়ার এমএসকে স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র জসীমুদ্দিনও ছিল ফুটবল পাগল। তারই সহপাঠী জনি শেখের কথায়, “সব পাড়াতেই ফুটবল খেলা হয়। কয়েকটা টুর্নামেন্টও হয়। এ দিনও নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলের আয়োজন ছিল স্কুল মাঠে। মল্লিকপাড়ার হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলছিল জসীমুদ্দিন। হঠাৎই এই দুর্ঘটনা।”
বছর চব্বিশের রবিউল শেখের স্ত্রী নাসিমা বিবির কোলে ৭ মাসের বাচ্চা। বাড়িতে শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেওর। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে দিন কাটে তাদের। এ দিন কাজ ছিল না। সুতির হারোয়া থেকে বাড়িতে এসেছিল শ্যালক আবদুল্লা শেখ (১২)। বাড়িতে খাওয়া সেরে রবিউল গিয়েছিল শ্যালককে নিয়ে মাঠে খেলা দেখতে। শ্যালক, জামাইবাবু দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে এই ঘটনায়। |