সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পাল্কির মা দেখলেন, বাড়ির সব বাসন চুরি গিয়েছে। পাল্কির দাদুর কাঁসার জামবাটিটা পর্যন্ত। কালই পাল্কির পুতুলের বিয়ে। সেই উপলক্ষে পুতুলের সব বাসন বের করা হয়েছিল। সেগুলো নেই দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছে পাল্কি। ও দিকে বাসনের অভাবে গৃহকর্তার অফিস কামাই আর পাল্কির স্কুলের অঘোষিত ছুটি। পাল্কি সারাদিন পুতুলের বাসনের দুঃখে কিছু খায়নি। শুধু বাবার বুকের ওপর শুয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। বাবা গা-মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বুঝিয়েছেন মনখারাপ করিস না, দেখিস বিকেলেই তোর পুতুলের সব বাসন কিনে আনব। পাল্কি চোখ মুছে বলে, চোরটা কী বদমাইশ বলো তো বাবা। পুতুলের বাসন কেউ চুরি করে? বাবা আদর করে বলেন, চোরের হয়তো তোমার মতোই একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। তার জন্যই হয়তো... বাবার কথা শেষ করতে না দিয়েই পাল্কি বলে, চোর তো কিনে দিলেই পারত, তুমি যেমন আমায় কিনে দিয়েছ। চোর পয়সা কোথায় পাবে বলো। ও তো আর আমার মতো চাকরি করে না।
একতলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ওপরে উঠে এলেন পাল্কির মা। বললেন, জানো, আমাদের বিয়ের কাঁসার বড় থালা দুটো ছাড়া আর কিছুই নেই। ভাগ্যিস থালা দুটো আমি খাটের তলায় ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। সামান্য রেগে গিয়ে বললেন, তিনি আবার বাসনের সঙ্গে আমার মোবাইল ফোনটাও গায়েব করেছেন। তাই নাকি, বলে পাল্কির বাবা কাগজে মন দিলেন। দাও তো তোমার ফোনটা, একটা রিং করে দেখি। ওমা এ তো সত্যি সত্যিই রিং হচ্ছে, বলে চিৎকার করে উঠলেন পাল্কির মা। অন্য দিক থেকে ঘুম-ভাঙা এক পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল, হ্যালো, কে বলছেন?
আমার মোবাইল ফোনটা চুরি করে এখন কে বলছেন! জানো, তোমায় আমি পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি।
আপনার মোবাইল ফোন চুরি করার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না। আপনাদের বাড়ির সামনেটা যা অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।
হ্যাঁ, স্ট্রিট লাইটটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা তোমার চুরি করার জন্য কি আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে নাকি? |
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
দেখলাম আপনার মোবাইলে টর্চ আছে। সেই জন্যই ওটা নিতে হল। চুরি করার হলে দাদার দামি ফোনটাই নিতে পারতাম। জানেন, আমার দু’দুটো মোবাইল। ঠিক আছে, ঠিক আছে অত কথার দরকার নেই। আপনার ফোন আমি ফেরত দিয়ে দেব। রাগ কমিয়ে মিসেস বসু মিষ্টি গলায় বললেন, ফেরত দিলে আমার খুব উপকার হবে। ওর মধ্যে সব দরকারি নম্বর সেভ করা আছে কিনা। চোরের তৎক্ষণাৎ জবাব, সে আমি জানি। না হলে ওই পুরনো রংচটা মোবাইল কেউ ফেরত চায় না। কাউকে বিনা পয়সায় দিলেও ওটা নেবে না। এই কথায় আবার মাথা গরম হয়ে গেল পাল্কির মায়ের। তিনি রেগে বললেন, বড় বড় কথা বলা বন্ধ করো। তুমি চোর চোরের মতো থাকবে। যাক গে, কবে ফেরত দিচ্ছ বলো? চোর নিমেষে বলল, আজই। মিসেস বসু শান্ত হয়ে বললেন, তা হলে দিয়ে যাও। চোর সবিনয়ে বলল, আপনি বরং আজ সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ি চলে আসুন। চা-টা খেয়ে আপনার মোবাইল আপনি নিয়ে চলে যাবেন। ও মা কী বলছে দেখো, বলেই মিসেস বসু পাল্কির বাবাকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন। হ্যালো বলতেই অন্যপ্রান্ত থেকে চোর নিচু গলায় বলল, নিশ্চয়ই আজ অফিস যেতে পারেননি স্যর। আপনার অফিস কামাই করানোর জন্য আমি দুঃখিত। আপনি বুঝতেই পারছেন, কাল সারারাত আমি ঘুমোইনি। তার ওপর সকালের গাঢ় ঘুম ভাঙিয়ে আপনার স্ত্রী আমাকে কী রকম অকারণে ধমকালেন। আমি বার বার বলেছি, আপনার মোবাইল আমি ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মিস্টার বসু চোরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, রাগ কোরো না। চোর পাল্কির বাবার কথায় গুরুত্ব না দিয়েই বলতে থাকল, জানেন আমাকে বিকেলবেলা বেরোতে হবে। বাসনগুলো বিক্রি করে যাব শপিং মলে। আমার মেয়ে, টুম্পাকে কথা দিয়েছি জিন্স আর টপ কিনে দেব। সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসব। আপনার স্ত্রীর হাতে মোবাইলটা তুলে দিতে না পারলে আমার মুক্তি নেই।
ঠিক আছে। কিন্তু আমার একটা রিকোয়েস্ট তোমায় রাখতে হবে।
বলুন। কী রিকোয়েস্ট?
আমার মেয়ের পুতুলের সব বাসনগুলো তুমি নিয়ে গেছ। কাল ওর পুতুলের বিয়ে। ও খুব কান্নাকাটি করছে। ওগুলো তুমি ফেরত দাও, প্লিজ। যা দাম লাগে আমি দিয়ে দেব। চোর গলা নরম করে বলল, পুতুলের বাসনগুলো চুরি করাই আমার ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছে। বলুন তো, পুতুলের বাসন কেউ চুরি করে? আর আপনাদের আক্কেলটাই বা কী রকম? বাড়ির বাসনের সঙ্গে পুতুলের বাসন কেউ রাখে? পাল্কির বাবা আর কথা না বাড়িয়ে চোরকে বললেন, তা হলে পুতুলের বাসনগুলো তুমি ফেরত দিচ্ছ তো? চোর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সে কী আর আমার হাতে আছে স্যর! টুম্পা কখন ওগুলো নিয়ে নিয়েছে। ওগুলো পেয়ে ওর এত আনন্দ আমি আর কখনও দেখিনি। বাসনগুলো ওর থেকে জোর করে নিতে গেলে টুম্পা ভীষণ দুঃখ পাবে, কান্নাকাটি করবে। একমাত্র মেয়ের কান্না কোন বাবা সহ্য করতে পারে বলুন। আমার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন স্যর। আমারও তো আপনার মতো স্ত্রী-কন্যা আছে। হতাশ মিস্টার বসু বললেন, হ্যাঁ, সে তো বটেই। দেখি মেয়েকে ম্যানেজ করতে পারি কি না। ঠিক আছে, পরে কথা হবে বলে ফোন কাটলেন।
সন্ধেবেলা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন করল চোর। পাল্কির বাবা তখন ল্যাপটপে কাজে ব্যস্ত। তবুও বিরক্তি প্রকাশ না করে ফোন ধরলেন। চোর উত্তেজিত হয়ে বলল, কী হল এলেন না? আপনাদের জন্য গরম শিঙাড়া-মিষ্টি এনে রাখলাম। আপনারা আসবেন বলে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢুকলাম। পাল্কির বাবা হেসে বললেন, কী করে যাব বলো, তোমার বাড়ি তো আমরা চিনি না। চোর বলল, একটা ফোন করলেই তো আমি মোড় থেকে আপনাদের নিয়ে আসতাম।
সে এক দিন না হয় যাওয়া যাবে। তুমি তো আমাদের বাড়ি চেনো। তোমার পক্ষেই সুবিধা হবে মোবাইলটা ফেরত দেওয়া। চোর হেসে বলল, আমি যাই আর আপনি পাড়ার ছেলেদের আগে থেকে বলে রেখে আমায় উত্তমমধ্যম দেন। আপনাদের পাড়ার ছেলেরা যে কী রকম, তা আমি বিলক্ষণ জানি। সে বার কেষ্টকে যা গণধোলাই দিয়েছিল! ওই চক্করে আমি নেই। আমার সাফ কথা, আপনারা আসুন, মোবাইল ফোনটা নিয়ে যান। পাল্কির বাবা হেসে বললেন, আমরা গেলে তুমি যদি আমাদের মারো? আপনাদের মারতে যাব কেন? আপনারা কি চোর? লজ্জায় বলে উঠল চোর। আমার খারাপ লাগছে, আপনার মেয়ের কথা ভেবে। কিন্তু টুম্পা যে কিছুতেই পুতুলের বাসনগুলো হাতছাড়া করতে চাইছে না। কী করব বলুন? কেমন আছে পাল্কি? ওর অভিমান কমল? মিস্টার বসু বললেন, এখন খানিকটা নরমাল। ওর এখন টিউটর এসেছে। মিষ্টি গলায় চোর বলল, আজ তো হল না, কাল কি আসবেন স্যর? পাল্কির বাবা বললেন, দেখি কী করি, বলে চোরের সঙ্গে কথা শেষ করলেন। একটু পরেই পাল্কির মা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পাল্কির বাবা বললেন, শোনো, চোর ফোন করেছিল। ওই আজ সন্ধেবেলা ওর বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, সেই জন্য। পাল্কির মা জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে তুমি? খানিকটা বিরক্ত হয়ে পাল্কির বাবা বললেন, ওকে আসতে বললাম। ও আসতে রাজি নয়। বিমর্ষ মিসেস বসু বললেন, তা হলে উপায়? মিস্টার বসু রেগে বললেন, তা হলে কি আমায় এখন চোরের বাড়ি ছুটতে হবে মোবাইল ফোনটা আনতে? মিসেস বসু ভয়ে ভয়ে বললেন, না, না আমি তা বলিনি। ছি ছি, চোরের বাড়ি আমরা যেতে যাব কেন? আর ও বললেই আমাদের যেতে হবে? ওর বাড়ি যাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। এ আবার কেমন আবদার। তার চেয়ে আমার মোবাইল যায় যাক। এই কথায় শান্ত হলেন পাল্কির বাবা, বললেন, চোরকে ফোন করে বলে দাও ওর মোবাইল ফেরত দেওয়ার দরকার নেই। ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি বলে দিচ্ছি বলেই পাল্কির বাবার ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে গেলেন মিসেস বসু।
পরদিন ভোরবেলা পাল্কির মা ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে দেখলেন, পাল্কি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পাশে পাল্কির প্রিয় পুতুলটা নেই। তার বদলে এক হাঁড়ি রসগোল্লা, চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন আর একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা, আপনার মেয়ে পাল্কির মেয়ে-পুতুলের সঙ্গে আমার মেয়ে টুম্পার ছেলে-পুতুলের বিয়ে হয়েছে। গায়েহলুদের মিষ্টি দিয়ে গেলাম। পাল্কির পুতুলের বাসনগুলো যৌতুক হিসেবে নিয়ে গেলাম। আশা করি পাল্কি আর টুম্পা দু’জনেই খুশি হবে। কাল সন্ধেবেলা বউভাত উপলক্ষে আপনাদের সকলের নেমন্তন্ন আমাদের বাড়িতে। |