পরিস্থিতিটা সুররিয়াল! মাঠে প্র্যাকটিস করছে ভারতীয় দল। আর পি সারাভানামুত্তু ওভালের গ্যালারির তলায় অস্থায়ী ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে বাজছে কিশোরকুমারের গান। মিউজিক সিস্টেমটাকে বোধহয় ফুল ভলিউমে করে দিয়েছে কেউ। গমগম করে গোটা মাঠে বাজছে পিয়া কা ঘর-এর সেই দুঃখের গান, ‘ইয়ে জীবন হ্যায়। ইস জীবন কা...।’ গানটাকে পিছনে করে মাঠের দিকে মুখ করা ওঁরা দু’জন। যুবরাজ আর ধোনি। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড হলে নির্ঘাত ছবিটা ছেপে পারস্পরিক শরীরী ভাষায় কী কী অস্বস্তি এক, দুই, তিন, চার করে ছাপত। এখানে কোনও ফটোগ্রাফারকে উদ্যোগী হতে দেখলাম না।
গানটা শেষ হতে না হতে আরও একটা দুঃখের গান। আবার কিশোর। ড্রেসিংরুমে টিমের যে ক’জন বেসরকারি ডিজে আছেন তাঁদের একজন অঙ্গসংবাহক রমেশ মানে। মুম্বইকর। সচিন থেকে কোহলিসবাই ভালবেসে ডাকে মানেকাকা। যুবরাজ বেশ কড়া ভাবে ডাকলেন তাঁকে। “মানেকাকা হচ্ছেটা কী! পরের পর দুঃখের গানে জ্বালাচ্ছ কেন?” দ্রুত কিশোর বন্ধ হয়ে একটা আইটেম নাম্বার শুরু হল। গায়ক মিকা। যুবরাজ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। ধোনি ব্যাপারটা পাত্তাই না দিয়ে ব্যাট করতে এগিয়ে গেলেন।
কলম্বোয় শনিবারের ভারতীয় দলকে দেখে কিন্তু পরিষ্কার মনে হল, কিশোরের দুঃখের গানটাই উপযুক্ত আবহ ছিল। এমন নয় যে টিম টুর্নামেন্টে কোনও ম্যাচ হেরেছে। রোববারের ইংল্যান্ড ম্যাচটাও তো হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃতীয় ওয়ার্ম আপ ম্যাচ। অনেক টুর্নামেন্টে গ্রুপ লিগের পয়েন্ট সুপার এইটে যোগ হয়েছে। আইসিসি-র টুর্নামেন্টেই আগে হয়েছে। এখানে সে সব নেই। সুপার এইট একেবারে শূন্য থেকে শুরু। কোনও কিছু ক্যারি ফরোয়ার্ড হয় না। |
ম্যাচকে দেখার ধরনটাই হওয়া উচিতটেনশনহীন আরও একটা ম্যাচ অনুশীলন ব্যবস্থা। অথচ তা একেবারেই নয়। আইপিএলের জন্মদাতা দেশ, টি-টোয়েন্টিতে প্রথম বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন একটা অনুশীলন ম্যাচের আগেও নার্ভাস মোডে রয়েছে ভাবাই যায় না। পিটারসেন-বিহীন ইংল্যান্ডেরও এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে আফগানদের ধ্বংস করা যদি একটা কারণ হয়। সবচেয়ে মারাত্মক হল, নিজেদের বোলিং শক্তি নিয়ে নিজেরাই এত সঙ্কুচিত থাকা। কামরান আকমলের একটা ইনিংস শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে দিয়েছিল। বাকি ঠকঠকানি এসেছে আফগানদের পাওয়ার হিটিং থেকে। ধোনি এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে জাহির খানের পক্ষে অনেক কথা বলে গেলেন। বললেন, “ব্যাটিংয়ে সচিন যা, বোলিংয়ে জাহির আমাদের কাছে তাই। সবাই জীবনে ওঠানামার মধ্য দিয়ে যায়। জাহিরকেও তো আমাদের সময় দিতে হবে।”
এমনিতে দু’হাজার বারো-র শ্রীলঙ্কা জায়গা হিসেবে ছুটি কাটানোর পক্ষে আদর্শ। সামনের সমুদ্রের ধারে অবাধ খাওয়াদাওয়া, বিচে পড়ে থাকা, স্নান, লোকজন সব সময় হাসিখুশি। দু’হাত জড়ো করে সম্পূর্ণ অপরিচিতকেও বলবেআয়ুবোয়ান। সিংহলিজ ভাষায়, স্বাগত। শহরের জায়গায় জায়গায় এখন বুদ্ধমূর্তি। যা বর্তমান প্রেসিডেন্ট মহেন্দ্র রাজাপক্ষ-র সরকার এসে লাগিয়েছে। মূর্তিগুলোর থিম সহজবোধ্যশান্তি। এই কলম্বোকে দেখলে বোঝারই উপায় নেই যে একটা সময় এ দেশ সম্পর্কে লেখা হত অশান্ত দ্বীপভূমি। ভারতীয় টিম হোটেলের কত কাছেই যে তখন এলটিটিই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কত প্রাণহানি ঘটিয়েছে। আউট অব ফর্ম পারফর্মারের স্নায়ু জুড়িয়ে নেওয়ার পক্ষে আদর্শ উপত্যকা হল এই কলম্বো।
জাহির খানকে তবু এত চিন্তাক্লিষ্ট আর যন্ত্রণাকাতর দেখাচ্ছে যেন সেপ্টেম্বর মাসে কলম্বোর তিনিই সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। দেশ থেকে দূরে থাকলে কী হবে। ব্ল্যাকবেরি, নেট আর চ্যানেলবাহিত হয়ে খবর তো সেই আসছেই যে জনমত-বিশেষজ্ঞ মত সব তাঁর বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক স্পোর্টস চ্যানেলে এখন নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে জাহির যাক, দিন্দা আসুক। কেভিন পিটারসেন পর্যন্ত বলে ফেলছেন, “আমি নিখুঁত ভাবে বলতে পারব না। তবে অ্যালান ডোনাল্ডের মুখে শুনছি, ডেথ-এ বেস্ট বোলার হল দিন্দা।”
এ দিন প্র্যাকটিস চলাকালীন কোচ-ক্যাপ্টেন দু’জনেই দিন্দাকে আভাস দিয়েছেন, তোমাকে খেলানো হতে পারে। ইংল্যান্ড ম্যাচে টাইট বোলিং করতে পারলে তবে সুপার এইটের সূর্যালোক দেখতে পাবেন। আর মনোজ তিওয়ারি এখনও জানেন না ভাগ্যে কী আছে? প্র্যাকটিস যদি নির্ণায়ক হয়, যে পরিমাণ অবহেলা ধোনির ভারত মনোজকে দিচ্ছে ভাবাই যায় না। অথচ সহ-অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর মনে করেন তাঁর পরিচালিত যে কোনও টিমে মনোজের নির্বাচন গ্যারান্টিকৃত। সকালে এমনও গুজব শোনা গেল যে, সহবাগকে ইংল্যান্ড ম্যাচে বিশ্রাম দিয়ে মনোজকে খেলানো যায় কি না ভাবা হচ্ছে।
সমস্যা হল এ মুহূর্তে ভারতীয় শিবিরের মেজাজ এতটাই মেঘলা যে, রোববারের ম্যাচের এগারো নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। সবার ঠকঠকানি সুপার এইটে কী হবে। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে দুটো ম্যাচ জিততে না পারলে এ বারেও সেই সেমিফাইনালের আগেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে জবাই।
কলম্বো ক্রিকেটবিশ্বের একমাত্র শহর যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এমন চারটে মাঠ রয়েছে। এসএসসি, ক্ষেত্তরামা, প্রেমদাসা আর এই পি সারা ওভাল। পি সারা মুরলীর ঘরের মাঠ আর শ্রীলঙ্কার প্রাচীনতম অনুষ্ঠানকেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। এশিয়ায় একমাত্র এই মাঠেই ব্র্যাডম্যান ব্যাট হাতে নেমেছিলেন। প্যাভিলিয়নে সেই ব্যাট করতে যাওয়ার বিরাট ছবিও রয়েছে। মুরলীর ছবির পাশে।
প্রাচীন সেই মাঠে ভারতীয় ক্রিকেট দলকেও সময় সময় মনে হচ্ছিল ব্র্যাডম্যানের যুগে ফিরে গিয়েছে। লালা অমরনাথের অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া সেই দলের মতোই যারা অনিশ্চিত, পরিকল্পনাহীন এবং আশ্চর্য হীনমন্যতায় ভুগছে। অমরনাথ বলতে গিয়ে মনে পড়ল গত ক’দিন টিমের অন্দরমহলের এক অংশে (এরা অধিনায়কের বিরোধী অংশ) জোর আলোচনা চলছে, মোহিন্দর অমরনাথকে কি সত্যি ধোনির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? রোববারে হচ্ছে জানতে পেরে ধোনি-বিরোধীরা খানিকটা দমে গিয়েছেন। উত্তরাঞ্চল থেকে নির্বাচন কমিটিতে নাম শোনা যাচ্ছে চেতন চৌহানের। দক্ষিণাঞ্চল থেকে রজার বিনি। মধ্যাঞ্চল অনিশ্চিত। পশ্চিমাঞ্চল থেকে আবে কুরুভিল্লা বা শ্রীনিবাসন-ঘনিষ্ঠ রমেশ পারিখ। পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে ঘোলাটে। ত্রিমুখী লড়াই হতে পারে। বাংলা থেকে অরূপ ভট্টাচার্যকে মানতে না-ও চাইতে পারে ওড়িশা। তাদের ক্যান্ডিডেট দেবাশিস মোহান্তি। ঝাড়খণ্ড আবার বলছে, তাদের লোক নিতে হবে। তারা অবিনাশ কুমারের নাম ভাসিয়েছে। নির্বাচক কমিটি যে ভাবে রূপ নিচ্ছে, ধোনির বিরুদ্ধে কথা আর তোলার লোক অবশিষ্ট থাকবেন বলে মনে হয় না।
অতীতে কখনও কে সিলেক্টর হবে, তা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের এত ঔৎসুক্য দেখিনি। যা দেখছি এ বারে। বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া, কোনও সেট টিমের মননে এ সব থাকারই কথা নয়। কিন্তু কোচ-ক্যাপ্টেনের টিম পরিচালনায় সেই সর্বাত্মক জবরদস্ত ভাবটাই নেই। শনিবার যাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী গেল সেই টাইগার পটৌডিও মাঠের বাইরে সবার সঙ্গে সমান ভাবে মিশতেন না। কিন্তু সিরিজ ঘিরে তাঁর ব্যক্তিগত একটা প্ল্যানিং থাকত। অথচ টিমের সিনিয়ররাই কেউ বলতে পারছেন না ১৫ নভেম্বর থেকে আমদাবাদে যে প্রতিহিংসার ইংল্যান্ড সিরিজ শুরু হচ্ছে তাতে ভারত অধিনায়কের ভাবনাটা কী? গ্যারি কার্স্টেন চলে যাওয়ার পর টিমের মধ্যে একে অপরে যোগাযোগ কমে গিয়েছে। শনিবার কেউ কেউ বলছিলেন, আমাদের মনোবিদও তো প্যাডি আপটনের পর আর দেওয়া হল না। যুবরাজ সিংহকে যে ভাবে দুম করে ফিরিয়ে আনা হল তাতেও খুশি নন অনেকে। মজার কথা হল, ভারত এখান থেকে আর চারটে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতলেই টেকনিক্যালি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে। সেটা সম্ভবও।
তবু টুর্নামেন্ট দ্বিতীয় অর্ধে পৌঁছনোর আগেই টিমকে মনমোহন সরকারের মতো দেখাচ্ছে। সরকার পড়েনি, কিন্তু পড়ার আগেই যেমন ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ দেখাচ্ছে, এটাও তাই। সুপার এইটের আগেই আস্থার অভাব। |