দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে
আলোকবৃত্তে
আসেননি।
অথচ, তাঁরা
গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক
মানচিত্রকে
রঙিন করে তুলেছেন।
মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নষ্ট হয়ে যায় একটি চোখের দৃষ্টি। বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ছোটাছুটি শুরু করলেন। কিন্তু দৃষ্টি ফিরল না। উল্টে চিকিৎসায় নানা টানাপোড়েনে আর একটি চোখের দৃষ্টিও হারিয়ে ফেলে কিশোরটি। না, এই আঘাতে ভেঙে পড়েনি কিশোরটি এবং তার পরিবার। বদলে প্রতিকূল অবস্থাকে সঙ্গী করেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শপথ নিয়েছিল কিশোরটি। সেদিনের সেই কিশোর রণবীর দত্ত আজ ভারতীয় রেলের একজন ঘোষক। বা বলা ভাল, দক্ষিণ পূর্ব রেলের প্রথম দৃষ্টিহীন ঘোষক।
দু’ চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলার পরে ভর্তি হয়েছিলেন বেহালার অন্ধ বিদ্যালয়ে। সেখানে নতুন করে শুরু হল ছাত্রজীবন। পরিচিত হলেন পড়াশোনার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পদ্ধতি ‘ব্রেইল’-এর সঙ্গে। “একেবারে নতুন জগৎ। তবে হাল ছাড়িনি। মেনে নিয়েছিলাম এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ক্রমশ এক ভিন্ন অনুভূতি। তবে উপলব্ধি করলাম, অন্য ইন্দ্রিয়গুলো অনেক বেশি সজাগ হয়ে উঠেছে। শব্ধ, গন্ধ স্মৃতিতে ধরে রাখার প্রখর ক্ষমতা তৈরি হল। এই যে আপনার কণ্ঠস্বর শুনলাম, জীবনে সামান্য সময়ের জন্যও ভুলব না।” কথা শেষ করে তারপর হেসে উঠলেন রণবীর। ফের যোগ করেন, “আসলে নদীর এক কূল ভাঙে, আর এক কূল গড়ে ওঠে।” |
মা-বাবার উৎসাহে শৈশব থেকে আবৃত্তি চর্চা শুরু। সেই পথ ধরে আজও বিভিন্ন সংস্থা থেকে ডাক পান রণবীর। খড়্গপুরে তাঁর গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক কর্ম ও আবৃত্তি চর্চার কেন্দ্র ‘শঙ্খমালা’র বয়স দু’দশক পেরিয়ে গিয়েছে। নিজের কর্মস্থলও খড়্গপুরেই। জানালেন, “১৯৭৭ সালে দক্ষিণ পূর্ব রেলে প্রথম দৃষ্টিহীন ঘোষক হিসাবে চাকরি পাই। তার পর জীবন আর থামেনি। শিক্ষিকা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এই বেশ ভাল আছি।”
আধুনিক টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে এগিয়ে চলেছেন রণবীর। হাতে বিশেষ ভাবে তৈরি দৃষ্টিহীনদের জন্য ঘড়ি। ঘড়ির কাচের ঢাকনা খুলে কাঁটার অবস্থান দেখে সময় জানা যায়। মোবাইলে আছে বিশেষ সফটওয়্যার, যা দিয়ে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর সময় ও মেসেজ শোনা যায়। আর আছে দৃষ্টিহীনদের জন্য ওয়াকিং স্টিক। চাকরি ছাড়াও দৃষ্টিহীনদের সঙ্গে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে যান। কোনারক থেকে সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে পৌঁছেছেন পুরী। গিয়েছেন সিমলিপাল, কাঁকড়াঝোড়, অযোধ্যা পাহাড়। নিজের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শোনাতে গিয়ে বললেন, “পাহাড়, সমুদ্র ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতিকে না দেখতে পেলেও অনুভব ও তীব্র কল্পনা শক্তি দিয়ে বুঝতে পারি। পায়ের শব্দের ছন্দের তারতম্যে বুঝতে পারি পৃথক মানুষের অস্তিত্ব।”
তা হলে স্ত্রী ছাড়া ঘরে অন্য মহিলা প্রবেশ করলে বুঝতে পারবেন? উত্তরে হেসে ফেললেন রণবীর। |