|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
সকলেই কাজে লাগিয়েছেন |
তাপস সিংহ |
এনিমিজ/আ হিস্টরি অব দ্য এফ বি আই, টিম ওয়েইনার। অ্যালেন লেন/পেঙ্গুইন, ৫৯৯.০০ |
পার্ল হারবারে জাপানি হানার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট যাবতীয় টেলিফোন কলের উপরে নজরদারির ক্ষমতা দিয়েছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফ বি আই) ডিরেক্টর জে এডগার হুভার-কে। সেটা ১৯৪১-এর ডিসেম্বর। আর ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর আল কায়দার হামলার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ প্রায় একই ক্ষমতা দেন এফ বি আই-এর ডিরেক্টর রবার্ট মুলারকে।
এর পরের ২৯ মাস ধরে এফ বি আই হাজার হাজার টেলিফোন লাইন এবং ই-মেলে লাগাতার নজরদারি চালায়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতি দিন যে অজস্র হুমকি ই-মেল আসত, সেগুলির ভাষা মোটামুটি এক: আমেরিকায় সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালানো হবে। ২০০৪-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি সেনেট সিলেক্ট কমিটির এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মুলার বলেছিলেন, ইতিমধ্যেই আমেরিকায় ঢুকে পড়া আল কায়দার লোকদের নিষ্ক্রিয় করাটাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
অথচ, সেই মুলারই গণতন্ত্র এবং গোপনীয়তার নীতি মেনে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বৈরথে নামতেও দ্বিধা করেননি। তাঁদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি ইস্তফা দেবেন।
সে কাহিনি পরে। কিন্তু, পুলিত্জার পুরস্কারে সম্মানিত নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক টিম ওয়েইনার এফ বি আইয়ের ইতিহাস লিখতে বসে এ রকমই অসংখ্য অকথিত কাহিনি শুনিয়েছেন। তাঁর বইয়ে বিবৃত হয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের নানা অধ্যায়। অবশ্যই তা এই গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকলাপের নিরিখে। বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে একে একে এসেছে ঠান্ডা লড়াই, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া অভিযান এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার দোহাই দিয়ে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের প্রয়াসের বিরুদ্ধে এফ বি আইয়ের গোপন লড়াইয়ের কথাও। এর আগেও ওয়েইনার তাঁর লিগাসি অব অ্যাশেস/ দ্য হিস্টরি অব দ্য সি আই এ গ্রন্থে বর্ণনা দিয়েছিলেন সি আই এ-র কার্যকলাপের, সঙ্গে ছিল ইতিহাস।
বস্তুত, আমেরিকার দুই গোয়েন্দা সংস্থা, সি আই এ এবং এফ বি আইয়ের কার্যকলাপ নিয়ে নানা কাহিনি ছড়িয়ে আছে গোটা বিশ্বে। টেলিফোনে আড়ি পাতা, শোবার ঘরে ক্যামেরা বসিয়ে রাখা, পাল্টা গোয়েন্দাগিরি, চুরি, সুন্দরী মহিলা পাঠিয়ে বিভিন্ন সরকারি কর্তা বা বিদেশি দূতাবাসের কর্মীদের প্রলুব্ধ করে তাঁদের শয্যাদৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা ও সেই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে তাঁদের দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করানো এ সবের অনেক কিছুই পরিচিত। এটাও অজানা নয় যে, আমেরিকার বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট নানা সময়ে এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলির হাতে আইন-বহির্ভূত নানা ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। কেউ তা করেছেন তাঁদের অন্ধ কমিউনিস্ট-বিরোধিতার জায়গা থেকে, কেউ বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে বাড়তে না দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে।
পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট, হ্যারি ট্রুম্যান কিংবা আইজেনহাওয়ারের মতো প্রেসিডেন্টরা যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এফ বি আই-কে চালিত করতে চেয়েছেন, পরবর্তী কালে জর্জ বুশ বা বারাক ওবামা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেই কাজই করেছেন। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে সর্বত্র রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কে জি বি-র ভূত দেখতেন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা। তাঁরা মনে করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্টরা চক্রান্তের জাল বুনছেন। কিন্তু, ধীরে ধীরে বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রটাই পাল্টে গিয়েছে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ধীরে ধীরে দুনিয়া জুড়ে মাথাচাড়া দিয়েছে সন্ত্রাসবাদ। ভয়াল হামলা আর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড পাল্টে দিয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অর্থ। ফলে বুশ এবং ওবামার আমলে সি আই এ এবং এফ বি আইয়ের কাজের ধারাও অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে।
টিম ওয়েইনার এফ বি আইয়ের যে ইতিহাস বিবৃত করেছেন, তা নিছক এই গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাস নয়। ক্ষমতার ইতিহাসও বটে। এফ বি আইয়ের জন্মলগ্ন থেকে তার ডিরেক্টর ছিলেন জে এডগার হুভার। ১৯৩৫ থেকে ১৯৭২। এই সময়ে ছ’-ছ’জন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। সকলের সঙ্গেই তাঁর সমান সখ্য ছিল, এমনটা নয়। তবে, সকলেই কম-বেশি কাজে লাগিয়েছেন তাঁকে। হুভার ধীরে ধীরে ক্ষমতার আর এক বিকল্প কেন্দ্রে পরিণত হন। কী রকম? চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন টিম। বলেছেন, হোয়াইট হাউসের সঙ্গে হুভার্টের বাড়ির সরাসরি টেলিফোন সংযোগ ছিল। আইজেনহাওয়ার তাঁকে কোনও প্রয়োজন হলে ফোন করতেন। কিন্তু তাঁর কাছে রিচার্ড নিক্সনের ফোন আসত দিনে দু’বার। সকালে আর গভীর রাতে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে হুভার্ট যখন বসতেন, তাঁর দু’পাশে বসতেন আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব এবং বিদেশ সচিব। অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর কথাকেই মনে করতেন আইন।
নিবন্ধের শুরুতে এফ বি আইয়ের বর্তমান ডিরেক্টর রবার্ট মুলারের প্রসঙ্গ এসেছিল। কেন আলাদা ভাবে মুলারের প্রসঙ্গ? ৯/১১-র ঘটনার পরে প্রেসিডেন্ট বুশ পাল্টা নজরদারি ও সন্দেহভাজনদের সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি পরিকল্পনার কথা ভাবেন। তার সাঙ্কেতিক নাম ‘স্টেলার উইন্ড’। কিন্তু আমেরিকার বিচার বিভাগের বেশ কয়েক জন আইনজীবী এবং বিচারপতিদের একটি অংশ মনে করেছিলেন, এই প্রকল্প অসাংবিধানিক এবং এর ক্ষমতা আরও নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। মুলারেরও ছিল একই অভিমত। এই নিয়ে আমেরিকার প্রশাসনিক মহলের শীর্ষস্তরে বিস্তর জলঘোলা হয়।
এই পরিকল্পনাকে আইনি বৈধতা দিতে বুশ যে কতটা মরিয়া ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে তাঁর পদক্ষেপে। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাশক্রফ্টের তখন অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের আই সি সি ইউ-তে। তাঁকে এই পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করাতে সেখানেই চিফ অব স্টাফ অ্যান্ড্রু কার্ড এবং হোয়াইট হাউসের কৌঁসুলি অ্যালবার্টো গনজালেসকে পাঠানোর নির্দেশ দেন বুশ। অ্যাশক্রফ্টের বিছানার পাশে প্রেসিডেন্টের লোকেরা এলেও তিনি স্বাক্ষর করেননি। এই পরিকল্পনাকে বৈধতা দিতে শেষমেশ বুশ নিজেই তাতে স্বাক্ষর করেন।
২০০৪-এর ১২ মার্চ মুলার তাঁর ইস্তফাপত্র লেখেন। বুশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুলার তাঁকে বলেন, বিচার বিভাগের কোনও নির্দেশ ছাড়া যদি এফ বি আই-কে বিনা পরোয়ানায় আমেরিকার নাগরিকদের তল্লাশি চালাতে হয় তা হলে তিনি ডিরেক্টর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন।’ বুশ প্রতিশ্রুতি দেন, এই কর্মসূচির আইনি ভিত্তি তিনি সুনিশ্চিত করবেন। মুলারও তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
টিম ওয়েইনারের এই গ্রন্থ নিছক গভীর অন্ধকারে ঢাকা ইতিহাসের বর্ণনা নয়। তা উন্মোচন করছে আরও গভীর সত্য! |
|
|
|
|
|