বাস্তবিকই বেঘোরে মৃত্যু।
শ্বশুরবাড়ি এসে মদের দোকানের খোঁজ করতে গিয়ে পড়শি গ্রামে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর কথাবার্তা, চাল-চলন দেখে সে গ্রামের বাসিন্দারা ঠাওরেছিলেন, ‘এ নির্ঘাৎ চোর!’ পুলিশ না ডেকে, শুরু হয় ‘জনতার শাসন’। লাঠি, বাঁশ, সাইকেলের চেন, পড়তে থাকে পিঠে, বুকে, মাথায়। মুখ থুবড়ে পড়ে সেই অচেনা গ্রামেই মারা গেলেন দিলীপ দাস (৪২) নামে সেই প্রবাসী জামাই।
বৃহস্পতিবার রাতে কৃষ্ণনগরের কাছে একতারপুরের ওই ঘটনায় পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। জেলা পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, “শুনেছি, দীর্ঘদিন পরে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন মাঝবয়সী ওই ব্যক্তি। শ্বশুরবাড়ির গ্রাম বা আশপাশের এলাকায় প্রায় কেউই তাঁকে চিনত না। ফলে, চোর সন্দেহে তাঁকে পিটিয়ে ছিল গ্রামবাসীরা। সে রাতে কারা তাঁকে পিটিয়েছিল খোঁজ চলেছে তাদেরই।”
দিনকয়েক আগে শ্বশুর মাখন দাসের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ ছিল। সুদূর মহারাষ্ট্রের কাউড়াপেট গ্রাম থেকে তাই স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভবানীপুর গ্রামে এসেছিলেন দিলীপ। মুলচেরা থানার ওই গ্রামে কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস তাঁদের। দিলীপের বাংলা উচ্চারণেও জড়তা ছিল। |
তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অকপটেই জানান, জামাই নেশা করতেন। কিন্তু নিজের ঠিকানা ছেড়ে এত দিন পরে শ্বশুরবাড়ি এসে ঘোর মদ্যপ দিলীপ পণ করেছিলেন, এ ক’দিন মদ ছোঁবেন না। বাড়ির উঠোনে বসে এক টানা প্রলাপের মতো আওড়ে যাচ্ছিলেন স্ত্রী ইন্দুমতী, “কত করে বললাম, রাতে বেরিও না। ক’টা দিন না হয়, নাই খেলে। শুনলই না। মদের নেশাই শেষ করে দিল গো সংসারটা!”
পরিবার থেকে পুলিশ, সকলেই জানায়, সন্ধ্যা হলে মদ না হলে চলত না তাঁর। মহারাষ্ট্রে গাঁ-গঞ্জে সাইকেলে সস্তা মণিহারি জিনিস ফেরি করে বেড়ানো দিলীপ অবশ্য শ্বশুরবাড়ি এসে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। আর যাই হোক এখানে মদ ছোঁবেন না। কিন্তু দিন কয়েক যেতেই নেশায় ছটফট করতে থাকেন তিনি। কোনও নেশা ছাড়লে যে ধরনের সমস্যা হয় (উইথড্রয়াল সিনড্রোম), দু’দিন ধরে তা-ও শুরু হয়েছিল তাঁর। পরিবারের লোকজন জানান, সারা গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাধ্য হয়ে বৃহস্পতিবার সকালেই গ্রামের এক হাতুড়েকে দেখানো হয়। তিনি কিছু অ্যালার্জির ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। তবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে নয়, এক সঙ্গে বেশ কয়েকটি বড়ি খেয়ে নিয়েছিলেন দিলীপ। খানিক নেশাতুরও হয়ে পড়েছিলেন। তারপরে, রাতে আর পারেননি। মদের খোঁজে প্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরেই বেরিয়ে পড়েছিলেন দিলীপ।
তাঁর স্ত্রী বলেন, “ও যে মদের খোঁজেই যাচ্ছে, বুঝতে পেরেছিলাম। তাই জামা দিতে চাইনি। রাগ করে গেঞ্জি পরেই বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে।” সে রাতে দিলীপ আর ফেরেননি। শুক্রবার আশপাশের গ্রামে খোঁজাখুঁজির সময়ে খবর আসে, একতারপুরে পড়ে রয়েছে একটি ক্ষতবিক্ষত দেহ। তাঁর শ্যালক গিয়ে শনাক্ত করেন জামাইবাবুকে।
এ দিন সকালে একতারপুরে গিয়ে দেখা যায়, তখনও পড়ে দিলীপের দেহ। পরনে জিন্সের প্যান্ট। খালি গা। শরীর জুড়ে আঘাতের চিহ্ন। কাছেই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের পরেশ সর্দারের বাড়ি। তিনি বলেন, “গ্রামে ক’দিন ধরেই খুব চুরি হচ্ছিল। রাতপাহারা শুরু হয়েছিল দিনকয়েক। বৃহস্পতিবার রাতে আমার কাকা মারা গিয়েছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। পাড়ার কয়েকজন যুবকও ছিল। রাত ২টো নাগাদ আচমকা ওই অচেনা লোকটিকে দেখে গ্রামের কয়েকজন তাঁর পরিচয় জানতে চান। জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এত রাতে গ্রামে ঢুকছে কেন?’ আর তাতেই হকচকিয়ে গিয়ে গায়ে চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটি দৌড়ে পাশের আমবাগানে গিয়ে ঢোকে। টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে তাকে বার করে শুরু হয় মারধর। আমি বাধা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মার খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হই।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানান, মারধরের সময়ে বার বার শ্বশুর ও শ্যালকদের নাম করে দিলীপ বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি চোর নন। পাশের গ্রামের জামাই। কিন্তু পিটুনি থামেনি। |