|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
রাতচরা সে পাহাড়ে
চার ধারা একত্র হয়ে ‘যোগ ফল্স’ নাম নিয়েছে। তাদের
ঝর ঝর ঝরে পড়ার ছন্দে মিশেছে রোদের গুঁড়ো। ঘুরে এলেন শান্তনু চক্রবর্তী |
|
গাড়ির ভিতরে গুনগুন, ‘তুমি যদি না দেখা দাও...।’
সবুজ পাহাড়ের গা দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে কখনও বেশ খানিকটা উপরে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। ভরদুপুরে হাল্কা কুয়াশা। দূরের বরফে সাদা শৃঙ্গ ঢাকা পড়েছে মেঘে। গাড়ির ভিতরে মুখ-ভারদের যুক্তি-তক্কো। আবার মাঝেমধ্যে মজার গপ্পো। তবু সাজানো রাস্তার অনেকটাই উপভোগ করা যায় না শুধু শৃঙ্গ আড়াল হওয়ার দুঃখে।
রাস্তার পাশে ছোট্ট চায়ের দোকানে গিয়ে বসতেই হঠাৎ অন্য রকম যেন দলের মেজাজটা। দুপুরে রোদ কম থাকায় ঠান্ডা খানিকটা বেড়েছে। চারপাশের সবুজ পাহাড়, রঙিন ফুল, ছোট ছোট কমলালেবুর গাছের পাশে চায়ের কাপ হাতে আড্ডায় বেশ মজেছে দলটা।
|
|
পৌরি অঞ্চলেরই ছেলে গাড়িচালক বিক্রম। সওয়ারিদের মুখে হাসি দেখে উৎসাহ বেড়েছে তাঁরও। ইচ্ছা হয়েছে একটু ঘুরপথে গন্তব্যে নিয়ে যাবেন তাঁদের। নিজের এলাকা বলে কথা! চা সেরে গাড়ি ছুটল নতুন উদ্যমে। মেঘ কাটুক না কাটুক, অতিথিদের মুখে হাসি ফোটাবেই বিক্রম।
ঘুরপথে পৌরি শহরে পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়িয়ে প্রায় রাত। ঘিঞ্জি শহর দেখে ফের মুখ ভার পর্যটকদের। অলিগলি, বাজারহাট পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে সরকারি আস্তানা। গাড়ি থেকে নেমে একটু এগোতেই হঠাৎ চমক। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গিয়েছে যেন হাজার প্রদীপের ঢাল। দূরে ধীরে ধীরে মেঘ কেটে উঁকি দিয়ে যায় শ্বেতাঙ্গী চুড়ো। সঙ্গে শিরশিরে হাওয়া আরও বাড়াচ্ছে উন্মাদনা। হইচই শুনে বেরিয়ে এলেন কেয়ারটেকার মোহন। “আরে, এই দেখেই এ রকম করছেন! কাল সকালে তো আরও কত কী দেখতে পাবেন। সূর্য ওঠার সময় গোটা শৃঙ্গ-মালা এখান থেকে দারুণ দেখায়।” সে সব শুনেই তো এখানে এসেছে দলটা। না হলে তারা বিশেষ ঘিঞ্জি শহরে ঘুরতে ভালবাসে না। |
|
পর্যটকদের রাত কাটল ভোর দেখার উৎসাহ ঘিরেই। ভোর অবশ্য ফের ভোগাল। মেঘ সরা দূরের কথা, সঙ্গে নামল বৃষ্টি। বরফে ঢাকা পাহাড় সারা সকাল চাপা রইল মেঘেই।
পরিকল্পনামাফিক দুপুরে ফের গাড়ি ছুটল খিরসুর উদ্দেশে। শৃঙ্গ কি তবে না দেখাই রয়ে গেল? না না। এখনও আশা আছে, জানাল ট্যুর প্ল্যানার গোপুকাকা। সে কারণেই তো খিরসু যাওয়ার কথা। সেখান থেকে যে বরফ-ঢাকা শৃঙ্গগুলো আরও অনেক কাছে। তাদের দেখা পাওয়া যাবেই।
হঠাৎ উত্তেজিত বিক্রম। গাড়ি থামিয়ে দিল পাহাড়ের ধারে। সামনে অল্প কিছু গাছ। পিছনে মেঘ সরে ঝকঝকে আকাশ। তার গায়ে তুলোর মতো ছড়িয়ে নীলকণ্ঠ, সুমেরু, চৌখাম্বা, কামের, মানা পিক, কেদারনাথেরা। পৌরি ফেরত গাড়ি সব একে একে জমা হল ওই রাস্তার ধারেই।
সবই তো দেখা হয়ে গেল, তবে আর খিরসু যাব কেন? চলো, বরং গাড়ি ঘুরিয়ে মুসৌরি যাওয়া যাক। হইহই করে উঠল দলের কেউ কেউ। যেতে রাজি নয় এক জন। “অত কলোনিয়াল হ্যাংওভার কেন তোমাদের? গিয়েই দেখ না খিরসু গ্রাম কেমন লাগে। শৃঙ্গ ছাড়া আরও কত কী দেখার আছে,’’ বলে উঠলেন বহু পাহাড় চষে বেড়ানো গোপুকাকা। একমাত্র সে-ই জানে কী ভাবে এক একটা পাহাড়ে এক এক রকম স্বাদ থাকে জলে। জানে, খিরসুর রেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে স্বল্প দূরত্বের পর্বত চুড়োটা দেখার অভিজ্ঞতা যে বাকিদের কাছে একেবারেই নতুন হবে!
ইতিমধ্যেই শৃঙ্গ দেখার দলে জুটে গেলেন এক দল খিরসু ফেরত। শুধু কি আর শৃঙ্গ দাদা, কত কী দেখার সেখানে, হইহই করে মত প্রকাশ অতি উৎসাহী দলটার। তাঁরা নাকি তেন্দুয়াকে রোদ পোয়াতে দেখে এসেছেন সেখানে। জঙ্গলের ভিতরে শীতে কাতর বাচ্চাদের নিয়ে রোজ দুপুরে রোদ ওঠার পরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসে মা-তেন্দুয়া। ক্যামেরার জুম-টা বিশেষ ভাল নয় বলে খালি তেন্দুয়াদের ছবি তোলা হয়নি।
ব্যস্, ফের নতুন করে উৎসাহী খিরসুগামী দলের খুদেরা। তেন্দুয়া না দেখে কি আর কলকাতা ফেরা যায়! চিড়িয়াখানায় দেখা চির-চেনা বাঘই যে এখানে তেন্দুয়া, তা তারা এ বারের ভ্রমণে আগেই জেনে গিয়েছে যে! অতএব, নতুন উদ্যমে গাড়ি ছুটল তেন্দুয়া দর্শনের সাধ মেটাতে।
কিছু ক্ষণেই গাড়ি ঢুকল খিরসুর সরকারি আস্তানায়। ছোট ছোট কটেজের পিছনে কাঁটা তারের বেড়া। ওপারের রাস্তাটা ছবির মতো নেমে গিয়েছে কুড়ি-পঁচিশ ঘরের একটা গ্রামে। তার পিছনেই ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। |
|
তেন্দুয়ারা কোথায় আসে?
সেখানকার এক কর্মীর গম্ভীর জবাব, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ওই গ্রামের কাছেই রোদ পোয়ান নাকি তেনারা। এ দিকেও চলে আসতে পারে পর্যটকদের সঙ্গে আলাপ জমাতে। থাকতে হবে তাই বেজায় সাবধানে। কখনওই একেবারে একা ঘর থেকে বেরনো নয়।
যে যত সতর্কই করুন না কেন, স্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের দলের হুল্লোড় দেখে তাদের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে তো হবেই। পিছনের ছবির মতো ওই রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়ে ছোট্ট গ্রামটায় থাকে তারা। পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট বাড়িগুলো দেখতে পিছু নেওয়া যায় ওই কচিকাচাদের। অতিথিদের সঙ্গে ভাব জমাতে বেশ উৎসাহী তারা সকলেই। আর সেই সুযোগে বাঘের মায়ের দর্শন যদি পাওয়া যায়, তবে তো কথাই নেই।
অত দূর যাওয়া হোক বা না-ই হোক, চত্বরটায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনে পড়তেই পারে পুরনো হিন্দি ছবিতে দেখা কোনও পাহাড়ি গাঁয়ের কথা। দুপুর থেকে বিকেল গড়াবে খুব তাড়াতাড়ি। হাওয়ায় শিরশিরে ঠান্ডা ভাব বুঝিয়ে দেবে, পাহাড়ের কোলে বসে চায়ের সময় হয়ে এসেছে। রাস্তা থেকে দেখা বরফে ঢাকা চুড়োগুলো এ জায়গায় আরও স্পষ্ট। যেন, যে কোনও সময়েই ছুঁয়ে দেখা যায় তাদের। শেষ বিকেলের আলোতে সেই বরফ হয়ে ওঠে আরও ঝলমলে।
সূর্যাস্তের পরে খিরসুর চেহারা দেখে অবশ্য শহুরেদের সাহস সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা ফেরত যেতে চাইতেই পারে। দরজা খুলে রাতের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার ইচ্ছে যতই থাকুক, রাস্তায় আলাপ হওয়াদের তেন্দুয়া দর্শনের গল্প মনে পড়তে বাধ্য। রাত থেকে ভোরের খিরসু সেই ভয়াবহ রূপ ধরে রাখে। এক বার সে রাত দেখে ফেললে, পর দিন থেকে ভাল লাগার ফাঁকে অবচেতনে মিলেমিশে যেতেই পারে সে ভয়। খিরসুর গ্রাম, পাইন-ওকের জঙ্গল, পাহাড় তখন নতুন করে উপভোগ করার! |
কী ভাবে যাবেন |
হরিদ্বার, হৃষীকেশ, দেরাদুন, মুসৌরি থেকে বাস যায় পৌরি পর্যন্ত। সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর
দেরাদুনের জলি গ্রান্ট। সেখান থেকে পৌরি শহর ১৫৫ কিমি। সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন
কোটদ্বারে।
সেখান থেকে ১০৮ কিমি পথ। হরিদ্বার পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে, ১৩৮ কিমি পথ ভাড়া
গাড়িতে যাওয়া যায়। পৌরি থেকে খিরসু গাড়িতে আধ ঘণ্টার রাস্তা। |
কোথায় থাকবেন |
পৌরি বড় শহর। সরকারি-বেসরকারি থাকার জায়গা রয়েছে। খিরসুতেও সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে। |
|
|
|
|
|
|
|