তাজ সমুদ্র হোটেলে সকালে ঘরের দরজায় বেল বেজেছে দেখে বার হয়েছিলেন ক্রিস গেইল। দেখেন হোটেল কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্য জন্মদিনের বিশাল কেক পাঠিয়েছেন। সেটা নিয়ে টিমের সঙ্গে ট্রেনিংয়ে যেতে না যেতে আরও একটা কেক লবিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম তাদের মহাতারকাকে পেয়ে উৎসব পালন করার আগেই গেইলের জন্মদিন জনতাই এক রকম পালন করে দিল!
আধ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে আরও একটা পাঁচতারা হোটেলে গেইলের মতোই লম্বাচওড়া এক ক্রিকেটারকে ঘিরে উত্তেজনা। লবিতে নামামাত্র ছেঁকে ধরছে উৎসাহীরা। তাঁর জন্মদিন ২৭ জুন। কেক কাটার কোনও ব্যাপার নেই। কিন্তু বাকি ইংল্যান্ড টিম ছেড়ে তাঁকেকেভিন পিটারসেনকে ঘিরেই যেন নাটক আর উত্তেজনা। প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টিতে এখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্টুয়ার্ট ব্রডের টিম খেলল আফগানদের সঙ্গে। শুধু খেললই না, আফগানদের ওপর যেন বোমাবর্ষণ করে ১১৬ রানে উড়িয়ে দিয়ে গেল। হোটেলে বসে টিভির দিকে চোখ রাখা ধোনির টিমকে আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু প্রেমদাসা প্রেসবক্সে বসা ব্রিটিশ প্রেসের মনে হল না তাতে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। দোতলার টিভি বক্সে বসা পিটারসেন। সবাই অসম্ভব কৌতূহলী। টিভিতে কি কিছু বললেন? অবশেষে কোনও ইন্টারভিউ দিলেন? পরে জানা গেল, তাঁকে স্টুডিওতে রাখা হয়েছে। স্টার কর্তৃপক্ষ মাঠে আনেননি। সেখানে স্টুডিওতে বসেই খেলা শেষে পিটারসেন বলে দিলেন, “ইংল্যান্ড মনে হচ্ছে গ্রুপ থেকে এক নম্বর হবে।” স্টুয়ার্ট ব্রড শুনলে হয়তো আশ্চর্যই হতেন।
প্রেসবক্সে প্রাক্তন ‘উইজডেন’ সম্পাদক এবং ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ক্রিকেটলিখিয়ে শিল্ড বেরিকে দেখা গেল তীব্র গজগজ করতে। “মচকাল তবু ভাঙল না পিটারসেন। আসলে বিকল্প আয়ের রাস্তা খোলা রয়েছে তো!” ইংরেজ সাংবাদিকেরা মনে করেন অহংকারী এবং স্বার্থপর পেশাদার ক্রিকেটারদের তালিকায় আজ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে এক নম্বর ছিলেন জিওফ্রে বয়কট। আর পিটারসেনের সাম্প্রতিক বিতর্ক বয়কটকে হ্যারি পটার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। বয়কট পৃথিবীতে একমাত্র ক্রিকেটার যাঁকে টেস্ট ম্যাচে ইংল্যান্ড অধিনায়ক পরিকল্পিত ভাবে রান আউট করিয়ে ছিলেন। কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল ইয়ান বোথামকে। যিনি নিউজিল্যান্ডে দলের স্বার্থবিরোধী স্লো ব্যাটিং করার অভিযুক্ত বয়কটকে রান নেওয়ার জন্য ডেকে রান আউট করে দেন। আজও বয়কট এর জন্য ক্ষমা করতে পারেননি বোথামকে।
কিন্তু পিটারসেন বনাম ইংল্যান্ড টিমের যা কাহিনি শুক্রবার রাতে প্রেমদাসা প্রেসবক্সে বসে শুনলাম তাতে সত্যি বয়কট শিশুপাঠ্য উপন্যাস। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত বিরোধ বেঁধেছিল তিন সিনিয়র ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট ব্রড, জিমি অ্যান্ডারসন ও গ্রেম সোয়ানের। কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকেও পছন্দ করেন না পিটারসেন। এর পরে তাঁর সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় জুনিয়র ক্রিকেটারদের। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে দু’জনের সঙ্গে লম্বা পার্টনারশিপ হয়েছিল তাঁর। ড্রেসিংরুমে ফিরে এঁদের উদ্ধত ভঙ্গিতে তিনি বলেন, “স্কুল ক্রিকেটারদের সঙ্গে ব্যাট করতে গিয়ে তো আমার প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে। কবে ব্যাটিংটা শিখবে।” এর পরে অ্যান্ড্রু স্ট্রসের সঙ্গে যখন সংঘাত শুরু হয়, কয়েক জনের নামে টেক্সট মেসেজ করেন পিটারসেন দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধু ক্রিকেটারদের। ব্রিটিশ প্রেসের ধারণা, দক্ষিণ আফ্রিকা ইংল্যান্ডে এ বার সিরিজ জিতে পয়লা নম্বর হতে এত মরিয়া ছিল যে, প্রথমেই তারা পথের কাঁটা পিটারসেনকে সরাতে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার টিম স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী গোপন এসএমএস হেডিংলে টেস্টের সময় ইংল্যান্ড মিডিয়ায় পাচার করে দেন ফ্যাফ দুপ্লেসি। যিনি চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে আইপিএল খেলেন।
এর পরে ঘটনার ঢেউ এমন উদ্দাম হয়ে ওঠে বিশ্ব ক্রিকেটে এমন অভিনব টালমাটাল কেউ দেখেনি। রিচার্ড বেইলি নামে নটিংহ্যামের এক কমেডিয়ান টুইটারে একটা গোপন অ্যাকাউন্ট খোলেন @কেপি জিনিয়াস। এতে ড্রেসিংরুমে ঘটা সমস্ত গোপন তথ্য টুইটার পাঠকদের জানানো হতে থাকে। টুইটারে ক্লিক মেরে পিটারসেন দেখেন অ্যাকাউন্টে বেইলির ছবিতে সঙ্গে স্টুয়ার্ট ব্রড। আর সেটাও তোলা অ্যাকাউন্ট খোলার ঠিক আধ ঘণ্টা আগে। এর পর থেকে চলতে থাকে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের স্রোত। টেস্ট-ওয়ান ডে দুই মিলিয়ে ১১ হাজারের ওপর রান থাকা পিটারসেনের মতো তারকা ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ড শেষ কবে দেখেছে বলা কঠিন। হয়তো ডেভিড গাওয়ারের পর দেখেইনি। কিন্তু ইংল্যান্ড বোর্ড এবং টিমের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পরেও যেহেতু তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চাননি, ভারত সফরে তাঁকে দলে রাখা হয়নি।
এ দিকে শুক্রবার দিল্লি থেকে ফোনে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের মহাকর্তা জানালেন, পিটারসেন আর ক’দিনের মধ্যেই তাদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন। পিটারসেনের সঙ্গে ডিডি-র চুক্তি বছরে বারো কোটি টাকার কাছাকাছি। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের সদর মনে করে, এত বড় চুক্তি থাকাতেই পিটারসেন এমন অহংকারী আর অনমনীয়। আবার দিল্লি ডেয়ারডেভিলস মনে করে জুনিয়রদের সঙ্গে কেপি-র ব্যবহার দারুণ। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মহাকর্তা বললেন, “শুধু জুনিয়র নয়, স্পনসরদের সঙ্গেও কেপি ভীষণ হিট।”
ক্রিস গেইলের বেলাতেও একই কাহিনি ছিল। একবার কেকেআরের হয়ে খেলে তিনি লর্ডস টেস্টের সকালে লন্ডন ঢোকেন! বছরখানেকেরও বেশি গেইলকে টিমের বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু দমানো যায়নি। বিশ্বব্যাপী তিনি মোটা চুক্তিতে টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়িয়েছেন।
ইন্টারেস্টিং হল, অন্য দেশের তারকা ক্রিকেটারদের সঙ্গে আবার এঁদের খুব ভাল সম্পর্ক। যুবরাজকে সাহস দিতে প্রথম ফোন করেছিলেন গেইল। তার পরের দিন পিটারসেন। যুবরাজ আজও ভীষণ অভিভূত হয়ে রয়েছেন এই দু’টো ফোন পাওয়ায়। যুবির ঘনিষ্ঠমহল মনে করে ধোনিও তাঁর প্রতি এত সহানুভূতি দেখাননি, যা দেখিয়েছেন গেইল বা পিটারসেন।
আসলে গেইল বা পিটারসেন চলনে-বলনে, ব্যবহারে একটা মনোভাব তৈরি করেছেন যে, তাঁদের আনুগত্য পেশার প্রতি যার নাম ক্রিকেট। সেটাই তাদের নাগরিকত্ব। দেশ নয়। দেশের হয়ে তাঁরা খেলেন ঘটনাচক্রে। তাঁদের আসল আস্তানা হল যেখানে বিশ্বের টপ ট্যালেন্টরা গা শোঁকাশুকি করে সেই আইপিএল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো যেমন একটা সময় প্রকাশ্যেই পর্তুগালে খেলার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করতেন। বা টিমমেটদের সঙ্গে বিবাদ মেটাতে উৎসাহী হননি, পিটারসেনও তাই। ইংল্যান্ড বোর্ড বড়জোর তাঁর টেস্ট এবং ওয়ান ডে ম্যাচই কেড়ে নিতে পারে। রোজগারের রাস্তা বন্ধ করতে পারে না। যখন ইংল্যান্ডের সিরিজ চলবে সেটাতেই কমেন্ট্রি দিয়ে বেশি রোজগার করবেন। অস্ট্রেলিয়ায় বিগব্যাশ খেলবেন। পেশার যদি চাহিদা থাকে, দেশ কতটুকু আটকাবে? দেশজ টিমমেটদের বৈরিতা কতখানি ক্ষতি করবে?
পিটারসেন এর আগে খেলতেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে। সেই ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক সিদ্ধার্থ মাল্য খুব পছন্দ করেন পিটারসেনকে। প্রকাশ্যে টুইট করেন তাঁকে। ইংল্যান্ড টিম এবং মিডিয়া মনে করে এই সবে পিটারসেনের মাথাটা আরও ঘুরে গ্যাছে। নিজেকে মহানায়ক ভাবতে শুরু করেছে। পিটারসেন নাকি জাঁক করে ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে বলেওছেন, তোরা কারা! আমার প্রবলেম হলে আমি রাহুল দ্রাবিড়কে ফোন করি। ওর কাছে জেনে নিই। রাহুলের দরজা যখন-তখন আমার কাছে খোলা।
এর পরে ক্ষুব্ধ ইংল্যান্ড টিমের কেউ ফোন করেন রাহুলকে। বলেন, ও যে এত কেতা মারছে এটা কি সত্যি? সত্যিই তোমায় যখন-তখন ফোন করে? রাহুল পড়ে যান অস্বস্তিতে। বলেন, “যখন-তখন নয়। তবে মাঝেমধ্যে করে এটা সত্যি।” টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দিতে শনিবার কলম্বো পৌঁছচ্ছেন দ্রাবিড়। আবার না ইংরেজ ক্রিকেটাররা তাঁকে ঘিরে ধরেন।
উপমহাদেশীয় কোনও কোনও তারকা ক্রিকেটারের মতে পিটারসেন নিয়ে ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে যা চলল তা নিয়ে সাহেবরা চিরকাল ভারত-পাকিস্তানকে নিয়ে হেসেছে। আজ ওদের পালা।
কিন্তু গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এটা মোটেও ড্রেসিংরুম বিতর্ক নয়। ড্রেসিংরুম গসিপটাও নেহাত ব্যাধির প্রকাশংমাত্র, ব্যাধি নয়। বিতর্ক ভারত-পাকিস্তান সমতুল্য কি না সেই আলোচনাটাই তাই অপ্রাসঙ্গিক। এটা আধুনিক ক্রিকেটারের আধুনিকতম সিনড্রোম। মমতা বনাম ইউপিএ-র চেয়েও অনেক সর্বাত্মক।
ক্লাব বনাম দেশ! |