কলকাতা এবং শহরতলিতে বছরে প্রায় ২৬ হাজার টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) তৈরি হয়। তার ৯০ শতাংশই পুনর্নবিকরণ বা প্রক্রিয়াকরণ হয় সর্ম্পূণ অদক্ষ হাতে বিপজ্জনক ভাবে। কারণ, কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রক অনুমোদিত ইলেকট্রনিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কোনও কারখানা এ রাজ্যে নেই। তবে আশার কথা, অনুমোদনহীন হলেও সম্পূর্ণ বেসরকারি ভাবে দু’টি বড় মাপের কারখানা কলকাতার কাছেই গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের যাবতীয় ইলেকট্রনিক বর্জ্য সেখানে পাঠানো নিশ্চিত করাই সব চেয়ে বড় সমস্যা।
অথচ, যে কোনও বর্জ্যের চেয়ে ই-বর্জ্য অনেক বেশি বিপজ্জনক। বাতিল কম্পিউটার, টিভি, সিডি প্লেয়ার, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, রেডিও, ওয়াশিং মেশিন, পাখা, বাল্ব, সুইচ ইত্যাদি ভাঙার পরে তার থেকে যেমন সোনা, তামা, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক পাওয়া যায় তেমনই তাতে থাকে পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়ামের মতো বিপজ্জনক ধাতুর যৌগ। বৈধ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করা না হলে, তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়ে।
কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ বা পুনর্নবিকরণের কোনও কারখানা এ রাজ্যে নেই। এখানে ই-বর্জ্যের যতটুকু প্রক্রিয়াকরণ হয়, তার সবটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকায় বছরে মোট ২৫,৯৯৯ টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়। তার সামান্য একটি অংশ কর্নাটক এবং উত্তরপ্রদেশে চালান হয়ে যায়। প্রক্রিয়াকরণ হয় সে সব রাজ্যের অনুমোদিত কারখানায়।
কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল, এ রাজ্যে যে প্রক্রিয়ায় ই-বর্জ্য পুড়িয়ে তার থেকে ধাতু নিষ্কাশন করা হয়, তা পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ই-বর্জ্যের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার গত পয়লা মে থেকে নির্দিষ্ট আইন জারি করলেও এখনও এ রাজ্যে তার কোনও প্রয়োগ নেই। অথচ ওই আইন জারি হওয়ার পর থেকে ই-বর্জ্যের অদক্ষ এবং বিপজ্জনক ব্যবহার অবৈধও বটে। তবে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ইদানীং আইনের প্রয়োগের চেয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উপরেই জোর দিচ্ছে বেশি। সম্প্রতি পর্ষদ ইলেকট্রনিক সামগ্রী ব্যবহারকারী ছোট-বড় সংস্থাগুলির মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য একটি সেমিনারের আয়োজন করে। ওই ধরনের সেমিনার সারা বছর ধরেই চলবে বলে পর্ষদ সূত্রে খবর।
বৈধ প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা নেই, অথচ ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ই-বর্জ্যের বৃদ্ধির হার পুর-আবর্জনার থেকে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু সেই বর্জ্য অবৈধ ভাবেই চাঁদনি চকের ফুটপাথে ভেঙে জড়ো করা হচ্ছে। বর্জ্য থেকে নানা উপাদান বার করে নিয়ে তা তপসিয়া, ট্যাংরা বা ফুলবাগানের বিভিন্ন বস্তিতে পুড়িয়ে নানা ধাতু নিষ্কাশন করা হচ্ছে। যে অংশগুলি সে ভাবেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না, তা অনেক সময়ে ফেলেও দেওয়া হয়।
এই শহরে ই-বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনর্নবিকরণের জন্য শেষ পর্যন্ত ভরসা সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রই। কারণ কোনও বড় বিনিয়োগকারী এ রাজ্যে ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণে আধুনিক প্রযুক্তির কারখানা খুলতে রাজি হচ্ছে না। অসংগঠিত যে ব্যবসায়ী এবং সংগ্রাহকেরা নানা ভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করেন, তাঁদেরই কয়েক জন মিলে ছোট দু’টি কারখানা তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছেন। দু’টি কারখানাই কলকাতার পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে একটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরে, অন্যটি উত্তর ২৪ পরগনার পাতুলিয়ায়।
ইদানীং পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কিছু লোক কাগজ বা অন্যান্য ফেলে দেওয়া জিনিস কেনার পাশাপাশি বাতিল ইলেকট্রনিক সামগ্রীও কেনেন। সেগুলি পাইকারদের কাছে চলে যায়। তাঁরাই অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে কোনও রকম নিরাপত্তা ছাড়াই সেগুলি ভেঙে, পুড়িয়ে তার থেকে মূল্যবান অংশ বার করেন। ‘দিশা’ নামে একটি সংস্থা অনেক দিন ধরেই ওই শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা ছড়ানোর কাজ করে চলেছে। সংগঠনের কর্ণধার শশাঙ্ক দেব মনে করেন, বড় বিনিয়োগকারী যখন রাজ্যে আসছে না, তখন ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি ওঁদের দিয়েই করাতে হবে। সে কাজের সময়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদেরই লাগাতার প্রয়াসে উত্তর ও দক্ষিণ শহরতলির ওই কারখানা দু’টি গড়ে উঠতে পারছে। |