|
|
|
|
বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে আস্থা রাখুন: মনমোহন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
তৃণমূলের ছয় মন্ত্রী ইস্তফা দেওয়ার পরে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বুঝিয়ে দিলেন, সংস্কার নিয়ে নরম হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। উল্টে ‘বিচ্ছেদপর্ব’ চুকে গেলে আর এক বার সিংহ গর্জনই শোনা গেল ৭ নম্বর রেস কোর্স রোড থেকে। যেখানে এক দিকে ছিল ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা। অন্য দিকে নাম না করে তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হুঁশিয়ারি, খুচরো ব্যবসায় এফডিআই না মানতে হয়, না মানুন। কিন্তু অন্যের অধিকার খর্ব করার আপনি কে!
সংস্কারের পদক্ষেপকে সাময়িক ভাবে ‘কঠিন’ মনে হলেও আখেরে যে তাতে লাভ হয়, সে কথা বোঝাতে গিয়ে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংস্কারের কর্মসূচি নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তাতে কান দেবেন না। বিশ বছর আগেও এমন হয়েছিল। কিন্তু সময়ই বলে দিচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে তাঁর সংস্কারের দাওয়াই স্বাস্থ্যবান করেছে দেশের অর্থনীতিকে। এ বারও তাই হবে। যে বার্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এ-ও বোঝাতে চাইলেন, সংস্কারের পদক্ষেপের প্রশ্নে তিনি নতুন নন। বরং পরীক্ষিত। সুতরাং তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারেন মানুষ।
এই বক্তৃতার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে রেলমন্ত্রী মুকুল রায়-সহ তৃণমূলের ছয় মন্ত্রী নিজেদের ইস্তফা দিয়ে আসেন। তার পর কংগ্রেসের সঙ্গে প্রথাগত ‘বিচ্ছেদ’ সম্পূর্ণ করতে রাইসিনা হিলসে গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে সমর্থন প্রত্যাহারের চিঠি পেশ করেন তৃণমূলের নেতারা। পরে তৃণমূলের এক সাংসদ দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তৃণমূল সরে যাওয়ায় তিনি দুঃখিত। যদিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মনমোহন যে বক্তৃতা দিলেন, সেখানে শোকসন্তাপের বদলে প্রত্যয় এবং পরোক্ষে তৃণমূলকে ‘জবাব’ দেওয়ার চিহ্নই ছিল।
চিত্রনাট্য আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলেন সনিয়া-মনমোহন। তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর মুহূর্তে কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠক হয়। সংস্কার নিয়ে যে ফিরে দেখার প্রশ্ন নেই, তা আগেই স্থির করে রেখেছে কংগ্রেস। সেই সংস্কার অব্যাহত রেখে বাজার চাঙ্গা করতে সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির রূপরেখা নিয়ে সেখানে আলোচনা করেন মনমোহন। তার পরেই জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেন তিনি। |
|
ইস্তফার আগে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তৃণমূলের মন্ত্রীরা। শুক্রবার প্রেম সিংহের তোলা ছবি। |
মনমোহন তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব কৌশলগত ভাবেই বক্তৃতার জন্য আজকের দিনটি বেছে নিয়েছেন। যাতে তৃণমূলের সমর্থন প্রত্যাহার ও সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা ঢেকে দেওয়া যায় পাল্টা প্রত্যয়ে। কংগ্রেস ও সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, একে তো প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি বিচলিত নন। বরঞ্চ আত্মবিশ্বাসী। সেই সঙ্গে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও মানুষের উপর আর্থিক বোঝা চাপানোর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন।
তবে রাজনীতির কারবারিরা সূক্ষ্ম বিচারে আরও একটি দিক দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, সরকারের সঙ্কটের মুহূর্তে ফের ‘ব্র্যান্ড মনমোহনকে’ ব্যবহার করতে চাইছে কংগ্রেস। যে মনমোহন অতীতে সংস্কারের সুফল এনে দিয়েছিলেন, তাঁকে সামনে রেখেই পুনরায় মানুষের আস্থা অর্জনে সক্রিয় সনিয়া।
প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ বক্তৃতায় তাই বারবারই ফিরে এসেছে তাঁর রাজনীতির প্রথম ইনিংসের কথা। নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসাবে যিনি আর্থিক উদারিকরণের মন্ত্র দিয়েছিলেন ভারতীয় অর্থনীতিকে। তাঁর কথায়, “১৯৯১ সালে কী পরিস্থিতি ছিল, আমি জানি। কিন্তু কঠোর পদক্ষেপ করে সেই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। অথচ উৎপাদন শিল্পে বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়ায় তখনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন অনেকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিদেশি সংস্থাগুলি দেশের যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি, ইস্পাত এবং গাড়ি শিল্পে কাজ পাচ্ছেন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যদি এখন সেই কঠোর পদক্ষেপ না করি, তা হলে আমার দায়িত্বের প্রতি সুবিচার হবে না।”
বিজেপি, বাম এবং সদ্য প্রাক্তন শরিক দল তৃণমূল যখন তাঁর সেই কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করছে, তখন ধরে ধরে প্রতিটি পদক্ষেপ আজ ব্যাখ্যাও করেছেন মনমোহন। ভর্তুকির বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে জানিয়েছেন, “গত বছর পেট্রোপণ্যের খাতে ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল সরকার।
এ বার ডিজেলের দাম না বাড়ালে সেই বোঝা দু’লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু সেই টাকা কে দেবে? টাকা তো আর গাছে ফলে না!” তাঁর কথায়, “ডিজেলের জন্য সব ক্ষতি মিটিয়ে ফেলতে গেলে ১৭ টাকা দাম বাড়াতে হত। কিন্তু মাত্র ৫ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। কেন না, অধিকাংশ ডিজেল বড় গাড়ি, ধনীদের এসইউভি আর কারখানায় ব্যবহার হয়। কিন্তু স্কুটার, মোটর সাইকেলে
মধ্যবিত্ত মানুষ চড়েন। তাই পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়নি।” একই ভাবে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের কারণও দেশকে বোঝাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে বলেছেন, খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা ঠিক। এমনিতেই দেশের বড় শহরে বড় বড় খুচরো কারিবারি ও শপিং কমপ্লেক্স রয়েছে। তার জন্য ছোট ব্যবসায়ীরা মার খাননি। বরং ছোট ব্যবসায়ীর সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে তিন গুণ বেড়েছে। খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ লগ্নি এলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরোক্ষে বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, কোনও রাজ্য খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নিতে বাধা দিতে চাইলে তা করতেই পারে। কিন্তু অন্য কোনও রাজ্যকে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই। |
|
|
এটা কঠিন সিদ্ধান্ত
নেওয়ার
সময়।
আর সে জন্য
আপনাদের বিশ্বাস,
সহমর্মিতা এবং
সহযোগিতা
আমার কাম্য।
মনমোহন সিংহ
প্রধানমন্ত্রী |
আম-আদমির নাম নিয়ে ক্ষমতার
অপব্যবহার করে আম-আদমিকে
শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনাই
কি স্পষ্ট হচ্ছে না?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মুখ্যমন্ত্রী |
|
সরকার ও কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, সংস্কারের প্রশ্নে এই আগ্রাসী অবস্থান অব্যাহত থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে বিমা, পেনশন, ব্যাঙ্ক বিল নিয়েও এগোতে চাইবে সরকার। যদিও বিরোধী দলগুলির আপত্তিতে সেগুলি সংসদে পাশ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু তখন প্রচার করা হবে, কংগ্রেস চেয়েছিল, বিরোধীদের জন্য পারেনি। এবং পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে আগামী বাজেট অধিবেশনের পর ভোটে চলে যাবে সরকার। তবে এই মুহূর্তে সরকারের অস্থিরতার আশঙ্কা যে বিশেষ নেই, তা-ও আজ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সমাজবাদী পার্টির প্রধান মুলায়ম সিংহ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত শক্ত করবেন না। তাৎপর্যপূর্ণ হল, মুলায়মকে এখন আগলে রেখেছেন বামেরাও। লোকসভার অকাল ভোট বামেরা চান না। বহিরঙ্গে কেন্দ্র বিরোধিতা রেখেও তলে তলে এই বিষয়টি তাঁরা মুলায়মকে বুঝিয়ে চলেছেন। একই ভাবে অকাল ভোট চান না মায়াবতীও। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, সে দিক থেকে তৃণমূল জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ায় সরকারের ভালই হল।
কারণ, সরকার এখন তবু কিছু কাজ করতে পারবে। তবে শেষমেশ সনিয়া-মনমোহনের এই ঝুঁকি নেওয়ার ‘সাহস’ রাজনৈতিক ভাবে কতটা কার্যকরী হয়ে ওঠে, এখন সেটাই দেখার। |
|
|
|
|
|