সিনেমা সমালোচনা...
প্লিজ, ছবিটা দেখে আসুন
খুব ভুল করলাম ‘বরফি’ দেখতে গিয়ে। ব্লানডার! রাত পোহালেই আমার নতুন ছবি ‘c/o স্যার’-এর শু্যটিং শুরু। তার আগে যদি পরিচালকের নিজেরই মনে হয়, ‘কিচ্ছু জানি না, পারি না’ বা ‘কিছুই করা হল না’....সেটা বড় বিরক্তির, হতাশার! না দেখলেই হত। অন্য কেউ দেখত, ভেঙে পড়ত।
আমার শু্যটিংও ওই একই পাহাড়ে। ওই এক টয়ট্রেনের গা ঘেঁষে আমারও ক্যামেরা চলবে, দৃশ্য তৈরির চেষ্টা হবে। তবে ম্যাজিকটা? হবে তো? ‘বরফি’র ম্যাজিকটা? টয়ট্রেনের লাইনের প্রতিটা ফিশপ্লেটে যখন খোদাই করে ‘অনুরাগ বসু’ লেখা, তখন আমি কোন বিশ্বাসে ‘অ্যাকশন’ বলব? ২০১২-র আকাশটা সবে যখন শরৎপনা শুরু করেছে, যখন অঝোর বৃষ্টির পরই আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা তৈরি হচ্ছে, তার পরেই ভেঙে হাতি, সিংহ, রবীন্দ্রনাথ হয়ে আবার মেঘ হয়ে যাচ্ছে...ঠিক সেই সময় বর্ষসেরার রাজমুকুট মৃত্যুঞ্জয়ী অনুরাগের মাথায় বসিয়ে দিল ‘বরফি’!
ফুল যে রকম না বলে ফোটে, কোনও উদ্দেশ্য ছাড়া দিনভর হেসে যায়, তার পর কাউকে না বলেই শুকিয়ে নুয়ে যায় ‘বরফি’ তেমনই এক ছবি। বরফি তেমনই এক চরিত্র। সরলতা আর পবিত্রতার এমন উৎসব ভারতীয় সিনেমা বহু কাল দেখেনি। তাই হয়তো সবার অলক্ষ্যে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির মুখ নতুন ঠিকানায় ঘুরিয়ে দিল ‘বরফি’! গোদা, গোটা, ক্ষমতা, মাংস, মেদ, ঘাম, যৌনতা, বগল, নাভি, স্তনের মানচিত্রের বাইরে কলম্বাসের মতো নতুুন একটা দ্বীপ খুঁজে বের করল অনুরাগ বসু। স্তম্ভিত মানুষ অনভ্যস্ত এক সম্মোহন আর আনন্দে আড়াই ঘণ্টা কাটার পর টের পেল, কী যেন একটা নতুন কিছু ঘটে গেল। পপকর্নও খাওয়া হল না। আবার পানপরাগের প্যাকেটটাও আড়াই ঘণ্টা খুঁজতে হয়নি।
বরফি
রণবীর, প্রিয়াঙ্কা, ইলিয়ানা, সৌরভ শুক্ল
কিছু লিখব না, ছবির গল্প বা চরিত্র নিয়ে। এ ছবিতে এমনিই ৪৫ শতাংশ কথা নেই। তাই আমিও কেবল কৌতূহলটুকুই লিখব। আবেগটুকুই লিখব। বাকিটা এই লেখা পড়ে যত জলদি পারবেন দেখে আসুন। অনেক কেন, অধিকাংশ ছবি নিয়েই অনেক অনেক লেখা যায়। ‘বরফি’ তার দলে নয়। ‘বরফি’ না বলা বাণী। ‘বরফি’‘সাউন্ড অফ সায়লেন্স’।
আমার ছবির নায়িকারা যখন শু্যটিংয়ে বলেন, ‘আমার লেফট প্রোফাইলটা ভাল’ বা ‘রাইটটা বেটার’, তাঁদের জন্য আমার একটাই প্রেসক্রিপশন, ‘বরফি’র প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। গ্লাস তখনই চোখে পড়ে যখন তাতে পানীয় কম থাকে বা থাকে না। কানায় কানায় পূর্ণ প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার পাত্র। অভিনয়ের সৌন্দর্যে নিজেকে অন্য ভাবে ভেঙেচুরে দেখাতে তাই ওঁর দ্বিধা হয়নি।
হালের প্রথম সারির নায়িকার এই সাহস একটা বড় উপপাদ্য সব অভিনেত্রীদের জন্য।
ইলিয়ানা আর বাঙালিয়ানা কী করে যে অনুরাগ মেশাল! অপূর্ব। বড় যত্ন নিয়ে ওঁর লুকটা তৈরি করা। নতুন অভিনেত্রীকে তাই অনেক সংযত ভাবে খরচা করেছেন পরিচালক। ক্লাইম্যাক্সে ইলিয়ানা চমৎকার। তবে ওঁকে বয়স্কার মেক আপে আমার ভাল লাগেনি। বা মেক আপটা ভাল না বলাই শ্রেয়। নানা ধরনের পোশাকে ইলিয়ানার মানিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাটা অনবদ্য। ওঁর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ওঁর চোখ আর কালো মণি!
কপূর পরিবারের সর্বকালের সেরা অভিনেতা এই ছবির ‘বরফি’। রণবীর কপূর। যত দিনে যাচ্ছে ততই রং বদলে চলেছে এই অভিনেতা। রাজ কপূরের ওপর চ্যাপলিনের একটা প্রভাব ছিলই। অথচ এই ছবিতে চ্যাপলিনকে যত বার মনে পড়েছে, রাজ কপূরকে তত বার মনে পড়তে দেননি রণবীর। এখানেই ওর গ্রেটনেস। হিন্দি ছবির খান বাজারে পেশিহীন রাজেশ খন্না জমানার আধুনিক সাধারণ প্রেমিক রণবীর। একটা উপযুক্ত শব্দ পাচ্ছি না যা বলে ওঁর প্রতি আমার ভাল লাগা বা উত্তেজনাটা পুরোটা বের করে দিতে পারি। শব্দের গণ্ডির বাইরে, বিশেষণের চৌকাঠের ওপারে পৌঁছে গেছেন রণবীর এই ছবিতে। অমন মায়া, অমন বুক-ব্যথা শেষ কবে কোন অভিনেতাকে দেখে হয়েছিল জানি না। শারীরিক দক্ষতা, অভিনয়, সংযম, ও দেহছন্দ এতটা যাঁর নিয়ন্ত্রণে, সেই ঘোড়াতেই আমি বাজি রাখলাম। আগামী বেশ কিছু বছর পেশিহীন দর্শকদের পেশিহীন নায়ক, অভিনেতা হয়ে এ ছেলে রাজত্ব করুন এই কামনা করি।
অনুরাগ বসু
আমার বিচারে এ ছবির সেরা প্রাপ্তি সৌরভ শুক্ল! এমন পুলিশের সন্ধান সত্যিই যদি জানতাম, কেবল তাঁকে নিয়েই একটা গোটা বায়োস্কোপ তৈরি হয়ে যেত! কী যে অসামান্য কাজ করেছেন শুক্ল! অকল্পনীয়! আমিও ওঁর মতোই ‘বড়লোক’। তাই স্থূল দেহের ক্ষমতা আর ম্যাজিক দুটোই ব্যক্তিগত ভাবে জানি। শরীরটা নিয়ে এমন অনায়াস গুগলি আর পাশাপাশি নিখুঁত সূক্ষ্ম অভিনয় আমার ঈর্ষায় গা জ্বালাও দিয়েছে, আবার মুগ্ধও করেছে। আলাদা করে তাই ‘বরফি’র সেরা সৌরভ শুক্লকে আমার ব্যক্তিগত ভাবে দশে দশ!
ছবির বাকি অভিনেতারা যথাযথ।
প্রীতমের সঙ্গীত অসামান্য এবং জনপ্রিয়। তাই কিছু লিখলাম না!
শো দেখে বেরিয়েই অনুরাগকে একটা ফোন করে ফেললাম। বহু দিন পর ওর গলাটা শুনলাম।

অনুরাগ: হ্যাঁ দাদা, বলো...হ্যালো ...দাদা বলো?
গলা দিয়ে একটাও কথা বার হল না আমার। ঘুমে যেমন চোখ বুজে আসে, থামানোই যায় না, আমার গলা বুজে এল। দলা পাকিয়ে সব সাজানো কথাগুলো আটকে থাকল বেয়াড়ার মতো! আমি কাঁদছি। ফোন কেটে একটা এস এম এস পাঠালাম।
“আবার পরে ফোন করছি। সরি! কান্ট টক নাও।”
বিকেলে একটু থিতু হয়ে আবার ফোন করলাম। অনেক কথা হল। তা নিতান্তই ব্যক্তিগত। যেটুকু জানাতে পারি, অনুরাগের অনুমতি নিয়েই লিখলাম।
আমি: মৃত্যুকে একদম কাছ থেকে দেখেছ তুমি। তার পর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সেকেন্ড ইনিংস খেলছ! তাই কি ‘বরফি’র মধ্যে এত বাঁচার, আনন্দের, প্রেমের উৎসব?

অনুরাগ:অসুখ ধরা পড়ার পর ‘বরফি’ আমার লেখা প্রথম গল্প। প্রথম ভাবনা। তাই হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল ছবিটা করার। জানি না কেন আমি এই গল্পটাই বলতে চাইছিলাম।
আমি: চেনা যোগাযোগের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা না বলে একটা প্রেমের গভীর গল্প বলার আইডিয়াটা কবে মাথায় এল?

অনুরাগ: ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ করে আমি একবার চোখ বন্ধ করে পুরো ছবিটা দেখেছিলাম। সব বুঝেছি। চোখ বুজেও সব দেখতে পেয়েছি। যদিও বিরাট হিট্ ছবি, তবু আমার মনে হয়েছিল যে, সিনেমা আর রেডিও প্লে-র মধ্যে তফাত কই রইল? তাই ভাবলাম শুধু কথার কথা না। মোমেন্টস্! এমন একটা ছবি করে যেটা চোখ বুজে থাকলে কিছু বোঝা বা দেখা যাবে না।
আমি: কাকে ট্রিবিউট— চ্যাপলিন না রাজ কপূর, না দু’জনকেই?

অনুরাগ: শুধু চ্যাপলিন। রাজ কপূরটা মাথাতেই রাখিনি। মূর্তি উন্মোচনের দৃশ্যে একটা প্যানে চ্যাপলিনের একটা কাট আউটের ঝলক আছে। আমি আর একটু স্টে চেয়েছিলাম। হয়নি।
আমি: ‘কাইটস্’ ফ্লপ এবং রাকেশ রোশনের অনুরোধের আসর ছিল। ‘বরফি’তে অনুরাগের আসরে মুক্তি পেলে?

অনুরাগ: অনেক অনেক। অনেক ডেমোক্রেটিক অ্যাটমস্ফিয়ারে বরফি তৈরি করতে পেরেছি আমি। স্বাধীনতা না পেলে ‘বরফি’র মতো কাজ করা যায় না। ‘কাইটস্’ তাই তৈরি হয়েছিল মাত্র, আমি নিজেকে নিংড়ে দিতে পারিনি পরিস্থিতির জন্য।
আমি: কলকাতা বা দার্জিলিং আমাদের ছবিতে এমনটা লাগে না কেন বলো তো? সুজয় বা তোমার চোখে একদম আলাদা? কেন? রহস্যটা কী?

অনুরাগ: ঠিক যে কারণে ‘স্লামডগ’-এ মুম্বই যেমন দেখিয়েছে আমরা দেখাতে পারিনি কোনও দিন। আসলে যেখানে আমরা থাকি বা হাজার বার যাই, সেখানকার অনেক কিছুই ‘টেকেন ফর গ্রানটেড’ হয়ে যায়। বাড়তি দেখাটা হয় না।
আমি: তোমার সবচেয়ে প্রিয় সংলাপ কোনটা বরফিতে?

অনুরাগ: “জিন্দেগিকে সবসে বড়া রিস্ক হোতা হ্যায় কোই রিস্ক না লেনা!”

বাকি যা কথা হল তা বন্ধু আর সহকর্মীর। ফোন রেখে জানালায় দাঁড়িয়ে। তুমুল বৃষ্টির পর মেঘ কেটে স্বচ্ছ নীল নীল আকাশের টুকরো বেরিয়ে পড়েছে। সুপুরি গাছের মাথায় শেষবেলার রোদ। ওই নীল আকাশের টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে বড় টুকরো, আরও বড় টুকরো হয়ে যাচ্ছে নিমেষে নিমেষে। মেঘের ঠিক পিছনে ঝকঝকে একটা আস্ত আকাশ, নীল হয়ে আছে। বেশ বুঝতে পারছি।
ওই আকাশটার জন্যই বাঁচতে হবে, আবার পিঠ সোজা করে ‘অ্যাকশন’ বলতে হবে। আস্তে আস্তে মনে হতে থাকল, ঠিক শু্যটিং শুরুর আগে ভালই হল বোধহয় ‘বরফি’টা দেখে। নইলে হয়তো টুকরো টুকরো নীলগুলো জুড়বার মনটাই তৈরি হত না। “জিন্দেগিমে সবকো সেকেন্ড চান্স তো মিলনা হি চাহিয়ে।”
তা হলে আমি কেন পাব না?
দেখি অনুরাগ -এর ছোঁয়ায় আমার পাহাড়ের গায়ে কী রং ধরে। দশে দশ না, সাড়ে নয় দিলাম। বাকি হাফটুকু তোমার পরের ছবির জন্য তোলা রইল বন্ধু।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.