|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
বিভিন্ন বিষয়ে গড়ে ওঠে শিল্পীর নান্দনিক চেতনা |
সম্প্রতি জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে অনুষ্ঠিত
হল প্রদোষ দাশগুপ্তের প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
প্রখ্যাত ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্তের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে এ বছর। ১৯১২ সালে তাঁর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায়। ১৯৯১-এর জুলাই মাসে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন দিল্লিতে। রামকিঙ্করের পর ১৯৪০-এর দশকের যে কয়েক জন ভাস্করের চর্চা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্য নানা দিগন্তে বিস্তৃত হয়েছিল এবং স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ে দীপ্ত হয়ে উঠেছিল প্রদোষ দাশগুপ্ত তাঁদের মধ্যে প্রধানতম একজন। ভারতীয় ধ্রুপদী ভাস্কর্যের দর্শনকে পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাস্কর্যের জ্যামিতিকতার সঙ্গে সমন্বিত করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব রূপপদ্ধতি। ধ্রুপদী স্থৈর্য ও উদাত্ততা এবং রোমান্টিক অন্তর্মুখীনতা ও প্রতিবাদী চেতনার দ্বৈতের মধ্যে আন্দোলিত হয়েছে তাঁর রূপকল্পনা। এই দুই বিপরীত অনুভবকে তিনি মিলিয়েছেন তাঁর কাজে। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’। এর প্রধান একজন সংগঠক ছিলেন তিনি। এ দিক থেকেও ১৯৪০-এর দশকের সমাজ-চেতনায় অন্বিত আধুনিকতার বিস্তারে তাঁর অবদান তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কবি, লেখক, শিল্পতাত্ত্বিক ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। |
|
শিল্পী: প্রদোষ দাশগুপ্ত |
জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। ৩৮টি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের আলোকচিত্র ও ড্রয়িং নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। প্রদশর্নীটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, যদিও তাঁর সৃজনশীল জীবনের অনেকটা দিল্লিতে কেটেছে, তবু কলকাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। ছেলেবেলায় তাঁর স্কুল জীবনের অনেকটা কেটেছে এই বাংলার কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছেন। ১৯৩২ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভাস্কর্যের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী। এর পর দীর্ঘ দিন কলকাতায় তাঁর কোনও একক হয়নি। শেষ একক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে তাঁর প্রয়াণের অল্প কিছু দিন আগে। এর পরে শতবর্ষ উদযাপনের এই প্রদর্শনীটি প্রথম কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল ললিতকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে।
প্রদোষ দাশগুপ্তের প্রথম ভাস্কর্য শিক্ষা লখনউ আর্ট কলেজে হিরণ্ময় চৌধুরীর কাছে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। লখনউতে তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকারের কাছে মার্গসঙ্গীতেও তালিম নেন। এর পর ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত মাদ্রাজ আর্ট স্কুলে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর কাছে ভাস্কর্য শেখেন। ১৯৩৭-এ লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন ভাস্কর্য বিভাগে। ভাস্কর্যশিক্ষায় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এই প্রেক্ষাপট, তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীত চেতনা এবং ১৯৩০ ও ৪০-এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ সবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব নন্দন চেতনা। এরই নানামুখী প্রকাশ দেখি আমরা আলোচ্য প্রদর্শনীর ভাস্কর্যে।
তাঁর রূপাবয়বকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে মুখাবয়ব ভাস্কর্য। ১৯৫০-এর করা ‘সাঁটুল গুপ্ত’ ও ১৯৪৭-এর ‘পরিতোষ সেন’-এর মুখের দু’টি ব্রোঞ্জ সংস্করণ এই প্রদর্শনীতে রয়েছে। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের অনেক কাজে অনেক সময়ই বিষয় উঠে এসেছে বাঙালি জীবনের দৈনন্দিনতা এবং সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা থেকে। এই প্রদর্শনীর ‘হাংরি ফ্যামিলি’ ১৯৬৭-র ব্রোঞ্জ সংস্করণ। ক্ষুধার বাস্তবতাকে ধরেছেন অভিব্যক্তিবাদী ভাঙনের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৩-এর ‘ইন বন্ডেজ’, ১৯৪৮-এর ‘জয় হিন্দ’ স্মরণীয়, যা এই প্রদর্শনীতে নেই।
পরিণত পর্যায়ে তাঁর ভাস্কর্যে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন গোলক, বেলনাকার ও শঙ্কু আকৃতির রূপাবয়ব নিয়ে। এর পর এসেছে ডিম্বাকৃতি বা ইলিপটিক্যাল ফর্ম নিয়ে তাঁর ভাবনা। ব্রাঁকুসির দর্শন ও ভারতীয় দর্শনের সাযুজ্য অনুভব করেছেন এর মধ্যে। এই মূলগত আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি অতীত ও বর্তমান, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছেন। এই ধ্রুপদী দর্শনই ভাস্কর্যে তাঁর নিজস্ব অবদান। ডিম্বাকৃতি রূপের যে প্রকাশ দেখি আমরা এই প্রদর্শনীতে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৮৪-র ‘ফিলসফার’, ১৯৭১-এর ‘জেনেসিস’, ১৯৭৩-এর ‘এগ ব্রাইড’, ১৯৭৫-এর ‘সান ওয়র্শিপাসর্র্’ ইত্যাদি। আর একটি মুগ্ধ হওয়ার মতো রচনা ১৯৭৮-এর ‘সূর্যমুখী’। শান্তিনিকেতনে দেখা সূর্যমুখী ফুলকে নারীর সঙ্গে একাত্ম করে নিয়েছেন। |
|
|
|
|
|