দরজায় ব্যাঙ্ক গ্যারাজে গাড়ি
ধার করে গাড়ি কেনার কথায় আঁতকে ওঠা লোক এখন বিলুপ্তির পথে। ডাইনোসরের মতো। বরং চাকরিতে ঢোকার পর বছর কয়েক যেতে-না-যেতেই নিজের পছন্দের গাড়ি বেছে ফেলছে আজকের প্রজন্ম। সটান পৌঁছে যাচ্ছে ব্যাঙ্কের কাছে। বা বলা ভাল, ওই ইচ্ছে এক বার জেনে ফেলতে পারলে, ব্যাঙ্ক বা সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এসে দাঁড়াচ্ছে সম্ভাব্য ক্রেতার দরজায়। মাসিক কিস্তির টাকা গুনতে এক বার রাজি হয়ে যাওয়ার পর গাড়ির চাবি ঢুকে পড়ছে পকেটে।
কিন্তু পুরো বিষয়টা শুনতে যতটা মসৃণ মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা নয়। কারণ, নিজেদের ব্যবসার খাতিরে ব্যাঙ্ক আপনাকে ঋণ দিতে আগ্রহী ঠিকই। কিন্তু সেই ধারের সীমা আছে। রয়েছে হাজারো নিয়ম-কানুন। হাতে রাখা দরকার প্রয়োজনীয় নথিপত্রও। তাই গোড়া থেকেই এই সমস্ত কিছু জেনে এগোনো জরুরি। তাই আজ ঠিক এই বিষয়গুলি নিয়েই আলোচনা করব আমরা। সেই সঙ্গে জেনে নেব, কোনও সমস্যা হলে কার কাছে যাবেন আপনি? কী ভাবেই বা পথ খুঁজবেন সেই সমস্যা সমাধানের? সব মিলিয়ে ভাবতে পারেন গাড়ি-ঋণের হাতেখড়ি।


এটা পুরোপুরিই নির্ভর করছে আপনার আর্থিক সঙ্গতির উপর। যেমন ধরুন, নিট মাস-মাইনের (যত টাকা হাতে পান) ৪৮ গুণ পর্যন্ত ঋণ দেয় কোনও ব্যাঙ্ক। কেউ আবার ধার দেয় নিট বার্ষিক আয়ের ৪ গুণ পর্যন্ত (সর্বোচ্চ ৭৫ লক্ষ টাকা)। অনেকের শর্ত আবার একটু কড়া। তাদের কাছে বার্ষিক বেতনের ৩ গুণ পর্যন্ত ধার পেতে পারেন আপনি।
তবে যাঁরা স্বনির্ভর বা ব্যবসায়ী, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দেওয়ার হিসেব কষে সংস্থার নিট মুনাফা বা মোট করযোগ্য আয়ের ভিত্তিতে। সেই হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে ছ’গুণ পর্যন্ত ঋণ দেয় তারা।


কিছু ব্যাঙ্কের কাছে গাড়ির দামের পুরোটাই ঋণ পেতে পারেন আপনি। তবে কিছু শর্ত থাকে। স্পষ্ট ভাবে তার খুঁটিনাটি জেনে নেওয়া জরুরি। চুক্তির আগে ওই সব শর্তের লিখিত কপি নিজের কাছে থাকা ভাল। তবে অধিকাংশ ব্যাঙ্কই ঋণ দেয় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। বাকিটা জোগাড় করতে হয় ক্রেতাকেই। এখন অবশ্য গাড়ি-বাজারের হাল খারাপ হওয়ায় বিক্রি বাড়াতে ঋণের পরিমাণ বাড়াচ্ছে অনেক ব্যাঙ্ক। শিথিল করছে শর্তও।

গাড়ির দাম দু’ভাবে বলা হয়
এক, ‘এক্স শো-রুম’। অর্থাৎ গাড়ি শো-রুম থেকে বার করতে কত টাকা দিতে হবে।
দুই, ‘অন রোড’। অর্থাৎ, গাড়ি কেনার পর রেজিস্ট্রেশন, রোড ট্যাক্স এবং ইনশিওরেন্স মিটিয়ে তা রাস্তায় নামানোর মোট খরচ।
দু’ধরনের দামের ভিত্তিতেই ঋণ পেতে পারেন আপনি।


গাড়ির ন্যূনতম সাজ-সজ্জা (মাড ফ্ল্যাপ এবং ফ্লোর ম্যাট), তার কিছুটা গাড়ি সংস্থা বিনামূল্যে দিতে পারে। কিন্তু আপনার যদি আর একটু গাড়ি সাজানোর শখ থাকে (সিট-কভার, স্টিয়ারিং-কভার, রিভার্স-সেন্সর ইত্যাদি), তবে আলাদা করে তার দাম মেটানোর জন্য তৈরি থাকতে হবে। সাধারণত এই খরচ ঋণের হিসেবে ধরা হয় না। কিন্তু এখন সেই খাতেও ধার দিচ্ছে কিছু ব্যাঙ্ক। গাড়ি সাজাতে ‘এক্স শো-রুম’ দামের উপর ৫% (সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা) অতিরিক্ত অর্থ মোট ঋণের হিসেবের মধ্যে ধরছে তারা।


প্রথমেই বলা ভাল, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে গাড়ি-ঋণে সুদের হার বিভিন্ন। এবং সুদের ধরনও দু’রকম। ফিক্সড বা অপরিবর্তিত (মেয়াদের পুরো সময়ে যে হার বদলাবে না) এবং ফ্লোটিং বা পরিবর্তনশীল (যা ওঠা-নামা করবে বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে)।
দু’ধরনের সুদেই ঋণ চালু আছে বাজারে। যেমন, কোনও ব্যাঙ্কে হয়তো সুদ ১০.৭৫% এবং তা পরিবর্তনশীল। আবার কোথাও তা ১০.৫০% এবং অপরিবর্তিত। কোনও কোনও ব্যাঙ্কে ফিক্সড সুদ আর একটু চড়া। ১১.৫০ থেকে ১৩.৫০ শতাংশ। গ্রাহকের যোগ্যতা, ঋণ শোধের ক্ষমতা ইত্যাদির উপর এই হার অনেকটাই নির্ভর করে বলে তাদের দাবি।
ঋণ পেতে পারেন ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও। তবে তাদেরও সুদ যথেষ্ট চড়া।


নতুন গাড়িতে এক, তিন, পাঁচ ও সাত বছরের জন্য ঋণ মেলে। প্রতিটিরই নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে।
যেমন, এক বছরে ঋণ শোধ করে দিলে দ্রুত চিন্তামুক্তি হয় বটে কিন্তু পকেটে চাপ পড়ে অনেক বেশি। তেমনই আবার একটি গাড়ির ‘সুস্থ আয়ু’ সাধারণ ভাবে পাঁচ বছর হওয়ায়, তার পর তা বিক্রি করতে গেলে ভাল দাম পাওয়া সমস্যা। ফলে সেই হিসেবে সাত বছরের ঋণ নেওয়া কাজের কথা নয়। সুতরাং, ঋণ শোধের ক্ষমতা অনুযায়ী ৩-৫ বছরের মেয়াদ বাছাই বাঞ্ছনীয়।


মনে রাখবেন, ঋণের অঙ্ক, তার মেয়াদ আর সুদের হার এক হলেই যে সব সময় কিস্তির অঙ্ক একেবারে এক হবে, তা নয়। কারণ, তা নির্ভর করে হিসাবের পদ্ধতির উপরেও।
একটু সহজ করে ভাবুন। যে কোনও ঋণেরই দু’টি অংশআসল আর সুদ। কিন্তু এই সুদের অঙ্ক সাধারণত দু’ভাবে হিসেব করে ব্যাঙ্কগুলি।
• অনেক ব্যাঙ্ক তা করে ‘ডেলি রিডিউসিং ব্যালান্স’-এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ, শোধ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি দিন যে ভাবে ঋণের অঙ্ক কমছে, তার উপর নির্ধারিত হয় সুদের পরিমাণ।
• অন্যেরা আবার বাছে ‘মান্থলি রিডিউসিং ব্যালান্স’-এর পদ্ধতি। অর্থাৎ, এখানে সুদ নির্ভর করে প্রতি মাসে ঋণের টাকা কমার উপর।

তবে হিসেবের পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, মাসিক কিস্তির (ইএমআই) মূল সংজ্ঞা কিন্তু একটাই। আসল ও মোট সুদের অঙ্ক যোগ করে তাকে মেয়াদের মোট মাস সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা।
সুতরাং, সংখ্যার কচকচানি এড়াতে অন্ধ ভাবে ব্যাঙ্ককে বিশ্বাস করবেন না। কিস্তি নির্ধারণের অঙ্ক মিলিয়ে নিন হাতে-কলমে। দেখে নিন কী ভাবে হিসাব করা হচ্ছে আপনার সুদ। প্রয়োজনে উদাহরণ হিসেবে আগের কোনও গ্রাহকের হিসেবপত্র দেখতে চান ব্যাঙ্কের কাছে।


অবশ্যই। গাড়ি কেনার সময়ে শুধু ঋণ আর তার সুদকে শেষ কথা ভাববেন না। তাই গোড়াতেই জেনে নিন সার্ভিস চার্জ, ডকুমেন্টেশন চার্জ, প্রসেসিং ফি, ইনস্পেকশন চার্জ, স্ট্যাম্প ডিউটি ইত্যাদি সম্পর্কে। না-হলে কিন্তু এ নিয়ে শেষে আপনাকে নাজেহাল করতে পারে ব্যাঙ্কগুলি।

এক নজরে
সুদের হার নয়, ঋণ বাছুন মাসিক কিস্তি দেখে।
কিস্তিই শেষ কথা নয়। তুলনা করতে যোগ করুন অন্যান্য খরচও।
ভাল ৩-৫ বছরের মেয়াদই।
আয়ের শর্ত মিললে, পেতে পারেন গাড়ির দামের পুরোটাই।
অনেকে দেয় গাড়ি সাজানোর খরচও।
কোনও ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় মাস-মাইনের গুণিতকে। কারও ভিত্তি বার্ষিক আয়।
ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে দেখা হয় করযোগ্য লাভ।

না। ন্যূনতম কিছু শর্ত অবশ্যই রয়েছে। তবে আপনার জীবিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে তা আলাদা। যেমন, চাকরিরতদের ক্ষেত্রে মোট বার্ষিক আয় এক লক্ষ টাকা হলেই ঋণ দেয় কোনও ব্যাঙ্ক। তবে সে জন্য তার আগে অন্তত দু’বছর চাকরি করতে হয় গ্রাহককে। এর মধ্যে এখনকার চাকরিতেই থাকতে হয় কমপক্ষে এক বছর। ঋণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে কৃষিজীবীদেরও।
আর একটি শর্ত রয়েছে। তা হল বয়স। কমপক্ষে ১৮ বছর না-হলে, ঋণ দেবে না কোনও ব্যাঙ্কই। কোথাও আবার তা ২১ বছর। অনেক ক্ষেত্রে থাকে বয়সের ঊর্ধ্বসীমাও। যেমন, ৬৫ বছর হওয়ার আগেই গ্রাহককে ঋণ শুধতে হয় কোনও কোনও ব্যাঙ্কে।


ঋণ নিতে ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা শুরুর আগেই গুছিয়ে ফেলুন নথিপত্রের ফাইল। সেখানে রাখুন
• সরকারি সচিত্র পরিচয়পত্র (যেমন ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট)
• আয়ের প্রমাণপত্র
• ঠিকানার প্রমাণপত্র
• নিজের ছবি
এর বাইরেও আরও কিছু আপনার কাছে চাইতেই পারে ব্যাঙ্ক। যেমন, অনেকে খতিয়ে দেখে বাড়িতে টেলিফোন সংযোগ আছে কি না। কিন্তু অন্তত উপরের চারটি জিনিস এখন থেকেই ফাইলবন্দি করে ফেলতে পারেন আপনি।


ঋণ নেওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতামান পেরোলে, সাধারণত গ্যারান্টার চায় না কোনও ব্যাঙ্কই। তবে তা না-হলে, অনেক সময়েই গ্যারান্টর দাবি করে তারা। যেমন, বছরে নিট আয় অন্তত ২.৫ লক্ষ টাকা হলে, তবেই ঋণ দেয় একটি ব্যাঙ্ক। কিন্তু আয়ের অঙ্ক তার থেকে কম হলে, পরিবারের এক জনকে থাকতে হয় ‘কো-বরোয়ার’ হিসেবে। কোনও কোনও ব্যাঙ্কে আবার এমনতেই স্বামী/স্ত্রীকে গ্যারান্টর হিসেবে থাকতে হয়। তবে সে ক্ষেত্রে স্ত্রী গৃহবধূ হলেও সমস্যা নেই। শুধু গ্রাহক যদি অবিবাহিত হন, তা হলে একজন ‘যোগ্য’ তৃতীয় পক্ষকে গ্যারান্টর হিসেবে চায় তারা।


গাড়ি কিনতে গেলে তো বটেই, এমনকী কারও ঋণে গ্যারান্টর হতে গেলেও দু’বার ভাবুন।
কারণ, যে কেউ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে কোনও রকম লেনদেন করলেই তাঁর ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে ক্রেডিট ইফর্মেশন ব্যুরো (ইন্ডিয়া) লিমিটেড (সিবিল)। ফলে, আপনি গ্যারান্টর হওয়ার পর সেই ঋণ শোধে কোনও সমস্যা হলে, পরবর্তী কালে ধার পাওয়ার যোগ্যতা কমবে আপনারও। সুতরাং সমঝে চলুন।


সব ঋণেই ন্যূনতম একটা সময় একেবারে প্রথম থেকেই বেঁধে দেওয়া থাকে। যার মধ্যে বাড়তি টাকা হাতে এলেও ঋণ আগাম শোধ করতে পারবেন না আপনি। করলে, তার জন্য জরিমানা গুনতে হবে আপনাকে। কোনও কোনও ব্যাঙ্ক আবার জরিমানা নেয় না। কিন্তু খতিয়ে দেখে ওই বাড়তি টাকার উৎস। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের আগে ঋণ শোধ করার পরিকল্পনা থাকলে, খাতা-কলম নিয়ে বসুন। দেখুন, জরিমানা দেওয়ার পরও সুদ না-গুনে সত্যিই কত টাকা বাঁচাতে পারবেন আপনি।


প্রথমে ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলুন। লিখিত ভাবে জমা দিন আপনার সমস্যা। দ্রুত তা মেটানোর চেষ্টা করুন সংশ্লিষ্ট শাখাতেই। শেষ পর্যন্ত সেখানে না-হলে, তার আঞ্চলিক দফতর বা মূল কার্যালয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কোথাও কোনও ভাবেই সুরাহা না-হলে, অভিযোগ জমা দিন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘ওম্বাডসম্যান’-এর কাছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.