|
|
|
|
আবার সিংহ গর্জন |
তখতের কথা না ভেবে সংস্কারে অনড় মনমোহন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সময় দিয়েছিলেন ৭২ ঘণ্টা। কিন্তু তেরাত্তির কাটতে দিলেন না মনমোহন সিংহ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ফের শুনিয়ে দিলেন সিংহ গর্জন।
প্রধানমন্ত্রী এ দিন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সঠিক সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে তাঁর কথায়, উন্নয়নের পথে হাঁটতে গেলে সাহস তো দরকারই, চাই ঝুঁকি নেওয়া ক্ষমতাও। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে পাশে পেয়ে যাওয়ায় এই হিম্মত দেখাতে পেরেছেন তিনি। এত দিনের যাবতীয় দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে কংগ্রেসও এখন বলছে, “অপ্রিয় সিদ্ধান্ত হলেও ডিজেলের দাম কমানোর সুযোগ নেই সরকারের।” সরকার ও দলের নেতৃত্ব এক সুর হওয়ার পরে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, সংস্কারের যে সিদ্ধান্ত গত দু’দিনে নিয়েছে ইউপিএ-২ সরকার, তা থেকে পিছু হটার কোনও প্রশ্নই নেই।
যোজনা কমিশনের বৈঠকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার পাশাপাশি মনমোহন আরও বলেন, “আমাদের দেশে জ্বালানি যে দামে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক দামের কোনও সঙ্গতি নেই। তাই সম্প্রতি ডিজেলের যে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা সঠিক দিশাতেই হয়েছে।” তাঁর কথায়, “এই নীতি পঙ্গুত্ব যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের বেশি হবে না। সে ক্ষেত্রে সার্বিক বৃদ্ধিও সম্ভব নয়।” প্রধানমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “দেশের আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ এখন খুব বেশি। সেই ঘাটতি পূরণে আরও বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির প্রয়োজন।” যারা এত দিন তাঁর বিরুদ্ধে নীতি পঙ্গুত্বের অভিযোগ তুলছিল, সেই আন্তর্জাতিক মহল আজ প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রথম সারির মার্কিন দৈনিকগুলি এ দিন তাঁর সিদ্ধান্তগুলিকে ‘দু’দশকে নেওয়া সব চেয়ে বড় আর্থিক সংস্কার’ বলে বর্ণনা করেছে। |
হিম্মতওয়ালা |
মনমোহন সিংহ
প্রধানমন্ত্রী
|
সকলের জন্য উন্নয়নের পথে
হাঁটতে সাহস তো দরকারই,
চাই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও। |
|
তৃণমূল
আসন ১৯ |
সমাজবাদী পার্টি
আসন ২২ |
মিছিলে হাঁটলেন মমতা। আবার বললেন, ‘মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখব।’ তার পরে কী? ইঙ্গিত দিলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। |
খুচরোয় বিদেশি লগ্নিকে সমর্থন না
করলেও ‘সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দূরে রাখতে’
কেন্দ্রকে আপাতত সমর্থন। |
বহুজন সমাজ পার্টি(আসন ২১) |
রতন টাটা |
খুচরোয় বিদেশি লগ্নির বিরোধী। কেন্দ্রে বাইরে থেকে সমর্থন কি না, ১০ অক্টোবর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। |
কায়েমি রাজনৈতিক স্বার্থের প্রবল বাধা সত্ত্বেও আপনাদের চেষ্টা অবশেষে সফল হয়েছে। |
বিজেপি |
২০ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধের ডাক।
গডকড়ীরা যোগাযোগ রাখছেন
বাম ও তৃণমূলের সঙ্গেও। |
মনমোহন সিংহ রাতারাতি যেন
বিদেশিদের সিংহম
হয়ে উঠেছেন।—নরেন্দ্র মোদী
|
বামফ্রন্ট |
অ-ইউপিএ, অ-এনডিএ দলগুলির সঙ্গে মিলে ২০ সেপ্টেম্বর ভারতব্যাপী ‘প্রতিবাদ দিবস’। রাজ্যে সিপিএমের হরতাল।
|
|
|
টি-২০ |
অন্য সব বন্ধ, হরতালের সঙ্গে ২০ সেপ্টেম্বরেই গোটা দেশে ব্যবসা বন্ধের ডাক। |
|
গত তিন বছর দ্বিধায় ভুগে হঠাৎ কী ভাবে সংস্কারের পথে একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জোর পেলেন মনমোহন? কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করেছেন, তা একাংশের কাছে সমাদৃত হচ্ছে। সেই সঙ্গে দুর্নীতির প্রসঙ্গ থেকে বিতর্কের মুখও ঘুরে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের কাছে এখন স্পষ্ট, এত দিন যে ভাবে সরকার চলছিল, তার থেকে বরং মনমোহনী দাওয়াই ভাল। এর ফলে যদি দেশ আর্থিক বিকাশের পথে ফেরে, তাতে অন্তত পরবর্তী লোকসভা ভোটে দল ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে। সামাজিক প্রকল্প রূপায়ণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
প্রকল্প রূপায়ণ তো পরের কথা, সরকার টিকবে তো? এই প্রশ্নের মুখে কাল থেকেই অহরহ পড়তে হচ্ছে কংগ্রেস নেতাদের। বিশেষ করে মমতার মতো শরিক নেত্রী যখন ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য। শুধু হুঁশিয়ারি দেওয়াই নয়, এ দিন খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি এবং ডিজেলে বর্ধিত দাম প্রত্যাহারের দাবিতে কলকাতায় পথেও নেমেছিলেন তিনি। এই দুইয়ের সঙ্গে তাঁর আরও দাবি, বছরে ৬টির বদলে ভর্তুকিতে ২৪টি রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার দিতে হবে।
কিন্তু মমতা কি সমর্থন তুলে নিয়ে সরকারকে ঠেলে দেবেন আর একটি আস্থা ভোটের দিকে, যেমন দিয়েছিলেন বামেরা, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে? এ দিন তৃণমূল নেত্রীর কথা থেকে কিন্তু অন্য ইঙ্গিত মিলেছে। মিছিল শেষের সভায় তিনি কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌগত রায়কে দেখিয়ে বলেন, “ওঁরা কোনও অংশে কংগ্রেসের মন্ত্রীদের থেকে কম নয়। কিন্তু ওঁদের তো কোনও কাজই দেওয়া হয় না। আমরা মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখব। মানুষ যেন ভুল না বোঝেন। কারণ মানুষের জন্যেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব, তা সে যতই কঠোর হোক না কেন!” এ দিন মমতা ফেসবুকে লেখেন, ‘আমরাও সংস্কার চাই। তবে সংস্কার মানে দেশের সব কিছু বেচে দেওয়া নয়। সংস্কারের সুফল যেন তৃণমূল স্তরে সাধারণ ও গরিব মানুষের কাছে পৌঁছয়’।
দলনেত্রীর এই সব মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র তাঁদের দাবি না মানলে, তৃণমূল মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। মমতার ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রেও রাতে তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। |
লক্ষ্য উন্নয়ন |
শনিবার যোজনা কমিশনের বৈঠকে আর্থিক দুর্বলতা কাটিয়ে লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে
৩টি চিত্রের কথা বলেন মনমোহন। সেগুলি হল... |
প্রথম চিত্র |
সকলের জন্য উন্নয়ন। দ্বাদশ যোজনায় প্রস্তাবিত নীতির যদি সঠিক রূপায়ণ হয়, তা হলেই এই উন্নয়ন সম্ভব। এর ফলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। কেন্দ্রের প্রথম লক্ষ্য এই পথে হাঁটা। |
দ্বিতীয় চিত্র |
রূপায়ণে ঘাটতি। পরিকল্পনা ঠিক ভাবে রূপায়িত না হলে প্রথমে যে উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব নয়। আর্থিক বৃদ্ধির হারও ৬-৬.৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। ধাক্কা খাবে সার্বিক উন্নতি। আশা করি এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে না। |
চিত্র তিন |
নীতি পঙ্গুত্ব। সকলের উন্নয়নের জন্য যে সব নীতি তৈরি হয়েছে, তার বেশির ভাগ রূপায়ণ করা যায়নি বলেই এই অবস্থা। এটা বেশি দিন ধরে চললে এক সময়ে আর্থিক বৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে আসবে। তা আমরা চাই না। বরং চাইব, দেশের স্বার্থে সবাই যেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেখেন। |
|
মমতা সমর্থন তুলবেন কি না, তাই নিয়ে আগাম হিসেব কষেই ডিজেলে ভর্তুকি কমানো থেকে খুচরোয় বিদেশি লগ্নি নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের পথে গিয়েছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “এই দুই সিদ্ধান্তের পরে তৃণমূল কত দূর যেতে পারে, এবং তার পরিণতি কী হতে পারে, তা হাইকম্যান্ড আগে থেকেই ভেবে রেখেছেন। তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলেও কংগ্রেস বিচলিত হবে না। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রে সংখ্যালঘু সরকার চলবে।” সংস্কারের কাজে থেমে না থেকে আটকে থাকা প্রকল্পে গতি আনতেও তৈরি হচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম আজ মনমোহনের নেতৃত্বে একটি জাতীয় লগ্নি পর্ষদ গড়ার (এনআইবি) প্রস্তাব দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও রদবদল করতে চাইছে কংগ্রেস। তৃণমূল মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব কাউকে দিতে হবে। সে জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখে নিয়ে তার পরে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চান সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব।
সরকারের অন্য দুই সহযোগী বিএসপি এবং সমাজবাদী পার্টি কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাও কংগ্রেসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সালে বামেরা সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে মুলায়মই রক্ষাকর্তা হয়েছিলেন। একই ঘটনা ঘটেছে এ বার রাষ্ট্রপতি ভোটের সময়েও। এ বার তিনি কী করবেন?
মুলায়মের সমস্যা বাড়িয়ে আজ তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক করে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করেন মায়াবতী। জানিয়ে দেন, কেন্দ্রে শাসক জোটকে সমর্থন দিয়ে যাবেন কি না, সে ব্যাপারে ১০ অক্টোবর তাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। মায়াবতীর এই ঘোষণার পরেই কেন্দ্রের ‘খুচরো’
সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন সপা নেতা তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিংহ যাদব। এ সব সত্ত্বেও কেউই জোর গলায় বলেননি, এখনই সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে তাকে আস্থা ভোটের মুখে ফেলা হবে।
সে কথা মাথায় রেখেই কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও আশাবাদী, সরকারের স্থায়িত্বে কোনও আঁচ আসবে না। কারণ, তাঁদের মতে এই মুহূর্তে সবাই যে নির্বাচন চাইছে, তা নয়। দলের এক রাজনৈতিক ম্যানেজারের কথায়, “গত কাল মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর তৃণমূল যখন চরমবার্তা দিয়েছে, তখন সপা নীরব ছিল। মায়াবতী তখন চিন্তায় পড়ে যান। তাঁর মনে হয়, মমতা সমর্থন তুলে নিলে মুলায়ম সেই শূন্যস্থান পূরণ করবেন। আর তাতে আরও শক্তিশালী হবে সপা।” এই পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে না পেরে আগেভাগে বিরোধিতার রাস্তায় নেমে পড়েন মায়া, যা দেখে মুখ খুলতেই হয় অখিলেশকে। কংগ্রেস শীর্ষ নেতারা তাই মনে করছেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে দু’দল বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা সমর্থন প্রত্যাহারের পথে যাবেন না। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এ কথা মনে করিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র পি সি চাকো বলেন, “বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির নীতি কোনও রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। তাই সেই নীতি প্রত্যাহারেরও প্রশ্ন নেই।” এই ব্যাপারে সোমবারই নোটিফিকেশন জারি করবে সরকার।
বিরোধীরাও অবশ্য চুপ করে বসে নেই। ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে বিজেপি। ২০ সেপ্টেম্বর এনডিএ ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে। বিজেপি তলে তলে যোগাযোগ রাখছে তৃণমূল এবং বামেদের সঙ্গে। বামেরা অবশ্য বিজেপির সঙ্গে একযোগে কোনও আন্দোলনে যেতে নারাজ। তবে তারা ইতিমধ্যেই পথে নেমেছে। ইউপিএ এবং এনডিএ-র বাইরে থাকা দলগুলির সঙ্গে মিলে ওই ২০ তারিখেই ভারতব্যাপী ‘প্রতিবাদ দিবসে’র ডাক দিয়েছে বামফ্রন্ট। সিপিএমের বর্ধিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ওই দিনই বাংলায় ‘হরতাল’ পালন করা হবে। ওই বৈঠকে প্রকাশ কারাট বলেন, সর্বাত্মক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে হবে। সিপিএমের আরও দাবি, কেন্দ্র যত ক্ষণ না বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করছে, তত ক্ষণ রাজ্য সরকার ডিজেলের উপরে বর্ধিত কর লাঘব করুক। তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে সাধারণ মানুষ। |
|
|
|
|
|