প্রায় রোজ একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে ওষুধের বিলের সামঞ্জস্য নেই। ডাক্তারের ফি এক দিনেই কয়েক হাজার টাকা! রোগীর ছুটির সময়ে বিলের অঙ্কটা তো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো!
অথবা চিকিৎসার ‘প্যাকেজ’ হয়তো দু’লাখ টাকার। ডিসচার্জের সময়ে দেখা গেল তা ঠেকেছে প্রায় তিন লাখে!
বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন ‘অতিরিক্ত’ টাকা আদায়ের অভিযোগ হামেশাই ওঠে। ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতে মামলার ছড়াছড়ি, স্বাস্থ্য দফতরেও অভিযোগের পাহাড়। অধিকাংশেরই নিষ্পত্তি হয় না। এই সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ বার যৌথ ভাবে উদ্যোগী হয়েছে। ভারতে হু-র প্রধান নাটা মেনাবদে জানিয়েছেন, আগামী ছ’বছরে এ দেশের জেলা-গ্রামীণ স্তরে স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো বাড়ানো যেমন জরুরি, তেমন শহরের বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমের উপরে আশু নিয়ন্ত্রণও প্রয়োজন।
বস্তুত আগামী ছ’বছরে ভারতের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন হওয়া উচিত, তা স্থির করতে হু-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজে নেমেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে হু-র একটা রিপোর্ট জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদের কাছে, যিনি সমন্বয় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার দায়িত্ব দিয়েছেন মন্ত্রকের বিশেষ সচিব কে দেশিরাজুকে। সেই মতো দু’তরফে দফায় দফায় বৈঠক চলছে বলে মন্ত্রক-সূত্রের খবর। মন্ত্রকের বক্তব্য: ‘পাঁচতারা’ হোটেলের ধাঁচে তৈরি বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় কেবিন-ভাড়াও সেই রকম। পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ বা ডাক্তারের ফি-ও ‘মানানসই।’ মেনাবদে’র কথায়, “এতে মুষ্টিমেয় লোকের অসুবিধে না-হলেও বাকিরা মুশকিলে পড়েন। রাজ্য সরকারগুলোর তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই কেন্দ্রীয় স্তরে ব্যবস্থা থাকা খুব দরকার।” ব্যবস্থা বলতে কী বোঝাতে চাইছে হু? |
লাগাম যেখানে |
• অপ্রয়োজনে ভর্তি রেখে বিল বাড়ানো
• ‘প্যাকেজ’-এর বাড়তি অর্থ দাবি
• দরকার না-থাকলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা
• প্রশিক্ষণহীন কর্মী নিয়োগ
• প্রতিশ্রুত পরিষেবায় ঘাটতি |
|
হু-র ব্যাখ্যা: বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীকে এমন অনেক ব্যয়সাপেক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়, যার আদৌ দরকার নেই। ডাক্তারের ফি-ও বেশ চড়া। এক ডাক্তার দিনে তিন বার রোগীকে ‘ভিজিট’ করলে তা আরও বাড়ে। হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মাসি থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হয় বলে ওষুধের দামও অনেক সময়ে বেশি দিতে হয় বলে অভিযোগ।
এই সব ‘স্বেচ্ছাচার’ রুখতেই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে। মন্ত্রকের খবর, নজরদারি কমিটি নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম বেঁধে দেবে। পাশাপাশি রোগীদের ‘অধিকার ও প্রাপ্য’ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে শুরু হবে বিশেষ কর্মসূচি। অভিযোগ জানানোর জন্য তৈরি হবে ওয়েবসাইট। হু-র টেকনিকাল অফিসার মধুর গুপ্ত বলেন, “ওষুধের দাম নিয়ে এথিক্যাল কমিটি তৈরির কথাও ভাবা হয়েছে। অক্টোবরের গোড়ায় এ নিয়ে মন্ত্রকের সঙ্গে বৈঠক হবে।” কেন্দ্রের স্বাস্থ্য-কর্তারা জানাচ্ছেন, রোগীরা যাতে হাসপাতালের ফার্মাসিতে যেতে বাধ্য না হন, সেটাও নিশ্চিত করার চেষ্টা হচ্ছে।
সরকারি নজরদারির আওতায় আসবে বেসরকারি হাসপাতালের ‘প্যাকেজ’-ও। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, অস্ত্রোপচারে বেসরকারি হাসপাতালে মূলত দু’রকম প্যাকেজ চালু রয়েছে। ওপেন প্যাকেজ আর ক্লোজড প্যাকেজ। হাসপাতালের তরফে বলা হয়, ক্লোজড প্যাকেজে খরচ বাড়ে না। ওপেন প্যাকেজে বাড়তেও পারে। কিন্তু অনেক সময়ে দু’ক্ষেত্রেই বাড়তি টাকা আদায় হচ্ছে।”
একই সঙ্গে নজরদারি চলবে বেসরকারি হাসপাতালে কর্মী নিয়োগে। এক স্বাস্থ্য-কর্তা বলেন, “বহু ব্যয়বহুল হাসপাতালেও প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান নেই। এমন নার্স রয়েছেন, যাঁরা রোগীর ভাষা বোঝেন না! বেসরকারি হাসপাতালে ‘মানের’ স্বীকৃতি দেয় যারা, প্রয়োজনে তাদের সঙ্গেও কথা বলা হবে।” দেশিরাজুর মন্তব্য, “সরকারি হাসপাতালে পান থেকে চুন খসলেই অভিযোগের পাহাড় জমে। অথচ বেসরকারি হাসপাতালে বিস্তর অনিয়ম হলেও ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট ছাড়া সরকারের হাতে প্রায় কিছুই নেই। অগত্যা নতুন ব্যবস্থার কথা ভাবতে হচ্ছে।”
এই প্রয়াসকে প্রাথমিক ভাবে স্বাগত জানিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টানর্র্ ইন্ডিয়া’ (এএইচইআই)-র বোর্ড অফ গভর্নর্সের সদস্য রূপক বড়ুয়া বলেন, “যারা সত্যিই বাড়তি টাকা আদায়ের চেষ্টা করে, এতে তারা হুঁশিয়ার হবে। তবে সরকারকেও বেসরকারি হাসপাতালের স্বার্থ দেখতে হবে। এর সঙ্গে বহু টাকার বিনিয়োগ জড়িত। আমাদের আশা, সরকার গোড়াতেই নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগোবে না।” মানের স্বীকৃতিদানকারী সংস্থাগুলোর অন্যতম ‘ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড ফর হসপিটালস’ (এনএবিএইচ) অবশ্য দাবি করেছে, তারা চিকিৎসা-ব্যবস্থা, প্রশাসনিক দক্ষতা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া, রোগীর নিরাপত্তা ইত্যাদি যাবতীয় কিছু যাচাই করেই হাসপাতালকে শংসাপত্র দেয়।
তা হলে মান নিয়ে সংশয় কেন?
এনএবিএইচ-কর্তারা জানাচ্ছেন, নিয়মে কিছু ‘ফাঁক’ থেকে গিয়েছে কি না, স্বাস্থ্য-কর্তাদের সঙ্গে বসে তা যাচাই করা হবে। |