মিলন নয়, চাই বিরহ। তাই দু’জনকে দু’পথে বয়ে যেতে হবে। এর পথ ওর পথের সঙ্গে মিললে চলবে না।
টাকা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে এমনটাই ‘মহাজনের’ নিদান। আর সে কথা জেনে যে ঋণ নেবে, তার প্রায় রাতের ঘুম ছোটার দশা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এডিবি) ঋণ পেতে হলে শহরের বৃষ্টির জল এবং বর্জ্য জল নির্গমনের পথ আলাদা করতে হবে। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ‘কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট প্রোজেক্ট’ (কেইআইপি)-কে এমনটাই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাতেই ফাঁপরে পড়েছে রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুরসভা। এডিবি-র ঋণ কেইআইপি পায় ওই মন্ত্রকের মাধ্যমেই।
এ শহরে বরাবর একই পাইপ দিয়ে বৃষ্টির জল এবং বর্জ্য জল বেরোনোর ব্যবস্থা আছে। একই পথে বয়ে সেই জল গিয়ে সরাসরি পড়ে গঙ্গায়। নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের বক্তব্য, এই দু’ধরনের জল আলাদা পথে নিকাশির ব্যবস্থা না করলে কেইআইপি-কে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের জন্য ধার্য দু’হাজার কোটি টাকা দেবে না তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, গঙ্গা-দূষণ এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত। কারণ, বর্জ্য জল এখন যে ভাবে সরাসরি গঙ্গায় পড়ে, তা বন্ধ করা খুব জরুরি।
দু’ধরনের জল আলাদা করার ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভার এমন কোনও ব্যবস্থা না থাকলেও দেশের অন্য একাধিক শহরে এই বন্দোবস্ত আছে। সেই সব জায়গায় বৃষ্টির জল সরাসরি নদী বা ঝিলে যায়, আর বর্জ্য জল পরিশোধনের পরে তা জলাশয়ে ফেলা হয়। সল্টলেক, নিউ টাউন কিংবা কল্যাণীর মতো নতুন উপনগরীগুলিও গড়ে উঠেছে দুই ধরনের জল নিকাশির আলাদা ব্যবস্থা রেখেই। কিন্তু কলকাতা প্রথম থেকেই ব্রিটিশ আমলের নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন পুরসভার আধিকারিকেরা।
কলকাতা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারেরা জানিয়েছেন, এখানে রয়েছে ‘কম্বাইন্ড স্যুয়ারেজ সিস্টেম’। সেই পদ্ধতি অনুযায়ী বর্জ্য পদার্থকে দু’টি পদ্ধতিতে গঙ্গায় ফেলা হয়। বৃষ্টি না হলে কিংবা ভারী বর্ষণ না হলে বর্জ্য জলের মাধ্যমেই বর্জ্য পদার্থ ‘স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’-এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ব্যাক্টেরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে ওই জলের দূষণ-মাত্রা কমিয়ে তা গঙ্গায় ফেলা হয়। ভারী বর্ষণ হলে বৃষ্টির জলের সঙ্গেই বর্জ্য পদার্থ জলীয় আকারে গঙ্গায় ফেলা হয়। ইঞ্জিনিয়ারেরা জানিয়েছেন, শহরে ভারী বৃষ্টি হলে বৃষ্টির জল আর বর্জ্যবাহী জল মিলে জলের জোর অনেক বেশি থাকে। সেই জল কলকাতার স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-এর পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। ফলে, ওই সব সময়ে আলাদা ভাবে বর্জ্য জল শোধন করা হয় না।
কেইআইপি সূত্রে খবর, নগরোন্নয়ন মন্ত্রক এই পদ্ধতি নিয়েই আপত্তি জানিয়েছে। তাদের ধারণা, এ ভাবে বর্জ্যবাহী জলের দূষণের মাত্রা কমে না। বরং ওই জল থেকে নদী (পড়ুন গঙ্গা) দূষিত হয়। ফলে, তাঁরা কেইআইপি-কে নির্দেশ দিয়েছেন, বৃষ্টির জল আর বর্জ্যবাহী জল নিকাশির ব্যবস্থা আলাদা করতে। কেইআইপি অবশ্য দাবি করেছে, বৃষ্টির জলের মাধ্যমে বর্জ্য যখন গঙ্গায় ফেলা হয়, তখন তার দূষণ-মাত্রা স্বাভাবিকই থাকে। সেই জলের নমুনাও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে পাঠাচ্ছে কেইআইপি।
এই শর্ত মানার ক্ষেত্রে কিছু ‘বাস্তব’ সমস্যার কথাও বলছে রাজ্য সরকার। পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “কলকাতা শহর সম্পর্কে ওঁদের ঠিক ধারণা নেই। এ শহরের রাস্তার নীচে বিদ্যুৎ, টেলিফোন বা পানীয় জলের লাইন এত ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে, যে সব জায়গায় এ ভাবে নিকাশি ও বর্জ্যবাহী জলের লাইন আলাদা করা সম্ভব নয়। কেন্দ্রকে সেটা বোঝাতে দিল্লি যাব।”
ঋণ না পেলে কলকাতার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত অনেক প্রকল্পের কাজই ধাক্কা খাবে বলে মনে করছে পুরসভা। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় সেই সমস্যার কথা লিখে নগরোন্নয়ন মন্ত্রককে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে।”
২০০১ সালে প্রথম পর্যায়ে কেইআইপি প্রকল্পের আওতায় রাজ্যকে ২০০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল এডিবি। সেই প্রকল্পের আওতায় অধিকাংশ কাজই শেষের পথে। কিন্তু গত মাসে নগরোন্নয়ন মন্ত্রক কেইআইপি-র সঙ্গে বৈঠক করে জানিয়ে দেয়, দ্বিতীয় দফায় এডিবি-র ঋণ পেতে হলে অন্যান্য রাজ্যের মতো কলকাতাতেও বৃষ্টি ও বর্জ্যবাহী জলের লাইন আলাদা করতে হবে। যা কার্যত সম্ভব নয় বলেই দাবি কলকাতা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের। |