খাদের কিনারা হইতে ফিরিয়া আসার কাহিনি বরাবরই মানবসমাজকে উদ্দীপিত, প্রাণিত করে। ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতা, মৃত্যুর নিশ্চিত হাতছানি, গভীর অতলে হারাইয়া যাওয়ার আশঙ্কার মোকাবিলা করিয়া মানুষ যখন সংগ্রামে, প্রত্যয়ে, সাহসিকতায়, কল্পনাশক্তিতে সটান শিরদাঁড়া সোজা করিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়, তখন মানুষ সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানায়। ভারতীয় ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহের প্রত্যাবর্তন তেমনই এক নাটকীয় রূপকথার উপাদানে সমৃদ্ধ। কঠিন ব্যাধি এবং কঠিনতর চিকিৎসার বিপুল ও তীব্র অভিঘাত অতিক্রম করিয়া তিনি ক্রিকেটের মাঠে ফিরিয়াছেন। তাঁহার এই প্রত্যাবর্তন লইয়া সংশয়ের অন্ত ছিল না। নির্ভেজাল ক্রিকেটীয় যুক্তিতে তাঁহাকে জাতীয় দলে নির্বাচন করা সঙ্গত হইয়াছে কি না, তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিতে পারে। যুক্তির উপর আবেগকে স্থান দেওয়া হইয়াছে এমন অভিযোগকে অহেতুক বা অযৌক্তিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইবে না। কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। মঙ্গলবার নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে কুড়ি ওভারের আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নামিয়াই যুবরাজ এক ইতিহাস রচনা করিয়াছেন। অসামান্য প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস।
অনিবার্য ভাবে মনে পড়িবে সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রং-এর কথা, যিনি একই ভাবে ক্যান্সারের আগ্রাসন হইতে ফিরিয়া আসিয়াও নূতন নূতন রেকর্ড গড়িয়াছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আর্মস্ট্রং যুবরাজ সিংহের ‘হিরো’ বা নায়কও বটেন। মাদক সেবনের দায়ে তাঁহার কীর্তি কাড়িয়া লওয়া হইলেও যুবরাজের শ্রদ্ধার আসন হইতে আর্মস্ট্রং এক ইঞ্চিও নীচে নামেন নাই। টেনিস খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামস কিংবা ক্রিকেটার ডেভ কালাহানের নামও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তাঁহারাও দুরারোগ্য ব্যাধির কোপ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন এবং নিজেদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখিয়াছেন। এই সকল প্রত্যাবর্তনই প্রকৃতপক্ষে মানুষ নামক প্রাণীটির অসামান্য সামর্থ্য ও মনোবলের প্রমাণ। এমন প্রমাণ চাক্ষুষ করিয়া সাধারণ মানুষও মনে মনে অসাধারণ প্রাণশক্তিতে জ্বলিয়া উঠিবার সমিধ সংগ্রহ করে। কয় জন তাহা পারেন, সেটা বড় কথা নয়। সম্ভাবনার দিগন্ত ক্রমাগত দূরে, আরও দূরে প্রসারিত করিবার এই প্রক্রিয়াটিই মানুষের মানুষ হইবার এক বড় সার্থকতা।
ভারত বীরের দেশ বলিয়া পরিচিত নয়। আমরা নিজেদের যতই পৃষ্ঠকণ্ডূয়ন করি, আন্তর্জাতিক বিশ্ব ভারতীয়দের চরিত্রে সেই লড়াকু জেদ, সেই লাগিয়া থাকার, সাফল্যের জন্য মরিয়া হইয়া ওঠার মনোভাব, শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা জয় করার দৃঢ়তা খুঁজিয়া পায় না। ভারতীয়রা বহুলাংশে পরাজয়বাদী, নিয়তিবাদীও। ভাগ্যের হাতে আপন ভবিষ্যৎকে সঁপিয়া নিশ্চেষ্টতার সাধনায় মগ্ন হওয়াতেই যেন তাহাদের নিশ্চিন্তি। রোগ-জরা লইয়া রোমান্টিক হতাশা, অসুখ-বিলাস আমাদের প্রায়শ পাইয়া বসে। হতাশা, অবসাদ, ক্লান্তি, গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবার অপারগতা যেন ভারতীয়দের জাতীয় চরিত্রের অঙ্গীভূত। যুবরাজ সিংহ এই প্রবণতায় এক মূর্তিমান ব্যতিক্রম। দেশবাসীর কাছে তিনি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, এক প্রেরণার উৎস হইয়া উঠিয়াছেন। তাই নব যুগের ভারতবাসী তাঁহাকে কুর্নিশ জানাইতেছে। |