লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে মার্কিন দূতাবাসে হামলা এবং রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্স সহ চার মার্কিন নাগরিকের নিধন সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছে। হামলার লগ্নটি ৯/১১-র একাদশ বার্ষিকী। হামলার উপলক্ষ হিসাবে অন্তর্জালে প্রদর্শিত ইসলাম-অবমাননাকর একটি চলচ্চিত্রের অংশকে শনাক্ত করা হইতেছে, যাহার নির্মাতা নাকি এক মার্কিন ইহুদি। বাক্স্বাধীনতার নামে মার্কিন গণতন্ত্র এ ধরনের উস্কানিমূলক অপকর্মকে প্রশ্রয় দিতেছে বলিয়াই কি অবধ্য মান্য মার্কিন দূতকেও ইসলামের ভূখণ্ডে প্রাণ দিতে হইতেছে? একই কারণে নাকি মিশরের রাজধানী কায়রোর মার্কিন দূতাবাসেও ব্রাদারহুডের সমর্থকরা বিক্ষোভ দেখান, বিক্ষোভ হয় প্রতিবেশী টিউনিসিয়ার মার্কিন দূতাবাসেও। দুই দিন পর ইয়েমেনের রাজধানী সানা-য় মার্কিন দূতাবাসেও একই ধরনের হামলা। স্বভাবতই ঘটনাগুলিকে রাজনৈতিক ইসলামের নূতন উন্মেষের সূচক রূপেই গণ্য করার প্রবণতা লক্ষ করা যাইতেছে, যে-ইসলাম ‘আরব বসন্ত’-র হাত ধরিয়া তথাকথিত ‘জুঁই বিপ্লব’-এর চেহারায় উত্তর আফ্রিকার মুসলিম ভূমিতে বছরখানেক আগে আত্মপ্রকাশ করে।
এই আরব বসন্ত যে দেশে দেশে স্বৈরাচারের পতন ঘটাইয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়ায় মৌলবাদী বা গোঁড়া মুসলিমদের ক্ষমতাসীন করিতেছে, সে বিষয়ে কোনও কোনও মহল হইতে আগেই সতর্কবার্তা জারি হইয়াছিল। সর্বাগ্রে যে দেশে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, সেই টিউনিসিয়ায় প্রেসিডেন্ট জিনে আল আবেদিন বেন আলি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় কার্যত কিন্তু কট্টর সালাফিপন্থীদের জয়জয়কার। মিশরে হোসনি মুবারকের অপসারণ মিশরে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সূচনা করে, তাহা মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করিয়াছে। আর লিবিয়ায় মুয়াম্মর গদ্দাফির স্বৈরশাসনের অবসানও ডাকিয়া আনিয়াছে সেই সব ইসলামি গোষ্ঠীকে, যাহারা এত কাল গুহার আঁধারে লুকাইয়াছিল। রাজনৈতিক ইসলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মূর্তিমান শয়তান’ বলিয়া শনাক্ত করে। ফলে ইসলামের ভুবনে গণতন্ত্রের হাত ধরিয়া ক্ষমতাসীন মুসলিম কট্টরপন্থীরা মার্কিন প্রতীক ও স্বার্থগুলির উপর হামলা চালাইবে, ইহা আর আশ্চর্য কী? তবে লিবিয়ায় এ ধরনের হামলার অন্য তাৎপর্যও রহিয়াছে। গদ্দাফির স্বৈরাচারের অবসানে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহিত মিলিত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে তৎপরতা দেখায়, পরিণাম বিচারে তাহার সহিত ইরাক হইতে সাদ্দাম হুসেনকে অপসারণের সামঞ্জস্য আছে। সাদ্দামের অপসারণ ইরাককে যে অরাজকতা, শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, সুন্নি জেহাদি সন্ত্রাস ও প্রতিস্পর্ধী শিয়া প্রতিরোধের রক্তস্নানের মধ্যে নিমজ্জিত করে, গদ্দাফি-বিযুক্ত লিবিয়াও অনুরূপ নৈরাজ্য ও জনজাতীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার। সেই সঙ্গে দুর্বল প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের তরফে জেহাদি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে দমন করার ব্যর্থতা লিবিয়াকে সন্ত্রাসের উর্বর সূতিকাগারে পরিণত করিয়াছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মর্মান্তিক পরিণতির জন্য অনেকে ওই দেশের ক্ষেত্রে অনুসৃত মার্কিন নীতিকেও দায়ী করিয়াছেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোনও স্বৈরশাসককে অপসারণের পর তাঁহার শূন্য স্থানটি পূরণ করিতে না পারিলে যে রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি হয়, জেহাদি গোষ্ঠীর বিকাশের পক্ষে তাহা অতীব অনুকূল। মিশরে ব্রাদারহুড শক্ত হাতে প্রশাসনের হাল ধরায় অরাজকতা অনেকাংশে এড়ানো গিয়াছে। কিন্তু টিউনিসিয়া কিংবা লিবিয়ায় বিশ্বাসযোগ্য ও মজবুত কেন্দ্রীয় শাসন-কর্তৃপক্ষের অভাবে পাশ্চাত্যবিরোধী রাজনৈতিক ইসলাম দ্রুত সংহত হইতেছে। ওয়াশিংটন সহ পশ্চিমী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি সিরিয়ার জন্য যে নকশা রচনা করিতে ব্যস্ত, তাহাও কিন্তু অনুরূপ বিপর্যয় ঘনাইয়া তুলিতে পারে। সে দেশে প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদ-এর শূন্যতা রাজনৈতিক ভাবে পূরণ করার মতো শক্তি বা সংহতি বিরোধীদের নাই। আসাদ বিদায় লইলেই বিরোধীদের ঐক্য ভাঙিয়া যাইতে পারে, মাথা চাড়া দিতে পারে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব, অরাজকতা, যাহার সুযোগে জেহাদিরা দখল লইতে পারে ক্ষমতার। সিরিয়ায় কিছু পদক্ষেপ করার আগে লিবিয়ার অশনি-সঙ্কেত হইতে সংশ্লিষ্ট সকলেরই শিক্ষা লওয়া উচিত। |