লাইনে দাঁড়িয়ে শীর্ণ চেহারার নুকু রাম। ওঁর নাম উপেনও হতে পারত, ‘দুই বিঘা জমি’-র উপেন।
পূর্ণিয়া জেলার মারওয়া গ্রামের বাসিন্দা, পঞ্চাশোর্ধ এই মহাদলিতের শেষ সম্বল বলতে ছিল এক চিলতে জমি। সেই জমিটুকুও দখল করে নিল গ্রামের উচ্চবর্ণের মাতব্বররা। থানা থেকে জেলাশাসক, প্রশাসনের তাবড় কর্তাদের অফিসে গিয়ে হত্যে দিয়েছেন নুকু। কোনও লাভ হয়নি। তবু আশা ছাড়েননি নুকু। টাকা জমিয়ে উজিয়ে এসেছেন পটনায়। ১ নম্বর অ্যানে মার্গে। সব আশাই তো গিয়েছে, একবার মুুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করবে নুকু। ফেরত চাইবে তার জমিটুকু।
অবশেষে লাইনে নম্বর এল নুকুর। চোখের সামনে সাদা ধবধবে পাজামা-পঞ্জাবি পরা নীতীশকে দেখে নুকু তখন বিহ্বল। কাগজের তাড়া শুদ্ধ কোনও রকমে জোড়হাত করে এগিয়ে গেলেন। কথা বলতেও যেন ভুলে গিয়েছেন। হঠাৎই তাঁকে আটকে দিলেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। হাত থেকে আবেদনপত্র নিয়ে তা জমা দেওয়া হল মুখ্যমন্ত্রীর সামনে রাখা টেবিলে। |
তার পরের এক মাসের ঘটনা নুকুর কাছে স্বপ্নের মতো। তাঁর মতো প্রান্তিক মানুষের বাড়িতেই এক দিন সকালে হাজির হলেন জেলা আধিকারিকরা। এঁদের কাছেই এক সময় কতবার নুকু গিয়েছেন নিজের আর্জি নিয়ে। কেউ কথা শোনেনি। এখন অবশ্য নুকুর দুঃখের দিন শেষ। মহাদলিত ওই মানুষটি ফিরে পেয়েছেন তাঁর জমি। শুধু নুকুই নয়। এমন অনেক গরিব-গুর্বো মানুষ প্রতি সোমবার জড়ো হন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের পিছনের গেটে, সার্কুলার রোডে। যার উল্টো দিকেই প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী, লালুপ্রসাদ-রাবড়ী দেবীর বাসভবন। ওঁদের চোখগুলো চকচক করে, সুবিচারের আশায়। পিছড়ে বর্গের ‘মসিহা’ হয়ে এসেও ১৫ বছরে লালুপ্রসাদ যা করতে পারেননি, নীতীশ কুমার যে সেটাই করে দেখিয়েছেন।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার সিদ্ধান্ত নেন, মানুষের অভাব-অভিযোগের কথা তিনি নিজে শুনবেন। তার জন্য ‘সোমবার’ দিনটিকে নীতীশ নির্দিষ্ট করেন জনতা দরবারের দিন হিসেবে। সেই থেকে প্রতি সোমবার মুখ্যমন্ত্রী হাজির থাকেন তাঁর জনতা দরবারে। মাসের প্রথম তিনটি সোমবার চলে এই দরবার। চতুর্থ সোমবার তিনি বৈঠক করেন দলের জেলা এবং ব্লকস্তরের নেতাদের সঙ্গে। কবে কোন দফতর সংক্রান্ত সমস্যা শুনবেন মুখ্যমন্ত্রী, সেটাও নির্দিষ্ট করা থাকে। সেই অনুযায়ী মন্ত্রী এবং আধিকারিকরা উপস্থিত থাকেন দরবারে। যেমন, মাসের প্রথম সোমবার থাকে পুলিশ সর্ম্পকিত সমস্যা। সেই দিন ডিজিপি-সহ পুলিশের সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্তারা সবাই উপস্থিত থাকেন দরবারে। এই দরবারে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এতটাই একনিষ্ঠ যে গত বছর তাঁর মায়ের মৃত্যুর দু’দিন পরেও, অশৌচ অবস্থানেও কামাই দেননি জনতা দরবারে। এমন সংগঠিত ভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সমস্যা জানানোর উপায় বিহারের মানুষের কাছে বড় পাওনা।
এই দরবারে নিজেদের সমস্যার কথা লিখিত ভাবে আগেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানাতে হয়। প্রথমেই তিনি শোনেন প্রতিবন্ধীদের কথা। মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রতিবন্ধীদের সামনে হাজির হয়ে শোনেন তাঁদের সমস্যার কথা।
এর পর, একে একে মহিলা এবং পুরুষদের অভিযোগ শোনেন। এই দরবারে মুখ্যমন্ত্রীকে শুনতে হয় নানা ধরনের সমস্যা। আসে কত রকমের আবদার। কী নেই তার মধ্যে! চাকরি থেকে বিয়ের সাহায্য, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া মেটানো, এমনকী অভিনয় করতে চেয়ে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার আবদারও! সকাল দশটা থেকে সব অভিযোগ-আবদার মুখ্যমন্ত্রী সারা দিন ধরে শোনেন। মাঝে শুধু এক ঘণ্টার বিরতি। সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে সমস্যাটি পাঠিয়ে দেন তৎক্ষণাৎ। পরে সেই সমস্যার কতখানি সমাধান হল, সেই বিশদও পাঠাতে হয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। নীতীশ কুমার ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম জনতা দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন ২০০৬ সালের ২০ এপ্রিল। তার পর থেকে কখনও বন্ধ হয়নি জনতার দরবার।
নীতীশ যখন জেলা সফরে যান, তখন সেখানেই বসে জনতার দরবার।
তবে জনতা দরবারে এলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, এমনটা নয়। বৈশালীর বিজয় যাদব সাইকেল মেরামতির কাজ করেন। বিজয়ের কথায়, “স্ত্রীর চাকরির জন্য জনতা দরবারে ২০ বার এসেছেন। কিন্তু ‘হবে’ বা ‘দেখছি’ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান সচিব অঞ্জনিকুমার সিংহের দাবি, “চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়েছে।” মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজেও মানেন, সব সমস্যার সমাধান হয় না। সে ক্ষমতা তাঁর নেই। অনেক আইনি সমস্যার তো সমাধান সরকার করতেই পারে না। মুখ্যমন্ত্রীর আক্ষেপ, “মানুষ অনেক আশা নিয়ে আসেন। তাঁরা খালি হাতে ফিরে গেলে খারাপ লাগে আমার, খুব খারাপ লাগে।” |