ছাইরঙা সাফারি স্যুটের দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় মঞ্চে উঠতেই দর্শকাসনে উঠে দাঁড়ালেন মুখ্যসচিব থেকে পুলিশ কমিশনার। সঞ্চালকের ঘোষণা, ‘সুস্বাগতম রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়’। টানটান দাঁড়িয়ে লালবাজারের শীর্ষ কর্তাদের স্যালুটের জবাবে প্রত্যভিবাদন জানালেন সাফারি স্যুট।
কাল: বৃহস্পতিবার বিকেল। স্থান: নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম। সাফারি স্যুট পরা প্রৌঢ়ের চলাফেরার প্রতিটি খুঁটিনাটি কয়েক ঘণ্টার জন্য রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল।
তিনি দেওনারায়ণ শর্মা। ৩৩ বছর ধরে কলকাতা পুলিশের কর্মী এখন সশস্ত্র পুলিশের সুবেদার। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায় আজ, শুক্রবার প্রথম আসছেন কলকাতায়। ইন্ডোর স্টেডিয়ামেই তাঁকে সংবর্ধনা দেবে রাজ্য সরকার। আর সেই অনুষ্ঠানের মহড়ায় দেওনারায়ণই ছিলেন রাষ্ট্রপতির ‘ডামি’। অবশ্য তিনি একা নন। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের ভূমিকায় সশস্ত্র পুলিশের আর এক সুবেদার দীপেন্দ্রনাথ দে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকায় পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের কনস্টেবল রিজওয়ানা খাতুন। রাষ্ট্রপতির ইন্ডোর স্টেডিয়ামে প্রবেশ থেকে প্রস্থান পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কে কখন কী করবেন সব কিছু এই ‘ডামিদের’ চলাফেরা থেকেই ঝালিয়ে নেওয়া হল। ‘রাষ্ট্রপতি’কে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করা থেকে কোনও আদবকায়দাই বাকি থাকেনি মহড়ায়। |
ইন্ডোর স্টেডিয়ামের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের অ্যাম্বাসাডরে সামান্য এগিয়ে প্রেক্ষাগৃহের কাছে থামলেন ‘রাষ্ট্রপতি’। তাঁকে স্বাগত জানাতে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন হাল্কা সবুজপাড় সাদা শাড়ির ‘মুখ্যমন্ত্রী’ ওরফে রিজওয়ানা। মঞ্চে উঠে ‘রাজ্যপাল’ ও ‘মুখ্যমন্ত্রী’র মাঝখানের আসনটিতে বসলেন ‘রাষ্ট্রপতি’। মঞ্চে যাঁদের বসার কথা, তাঁদের সকলেরই ‘ডামি’ হাজির ছিলেন এ দিনের মহড়ায়। ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়’, ‘দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়’, ‘কল্যাণী কাজী’, ‘যোগেন চৌধুরীরা’ পরপর উঠে ‘রাষ্ট্রপতি’র হাতে স্মারক তুলে দিলেন। চলল নমস্কার, প্রতি নমস্কারের পালা। অনুষ্ঠানের নির্ঘণ্ট অনুযায়ী চিত্রশিল্পী ‘শুভাপ্রসন্ন’-এর ডামি দর্শকাসন থেকে মঞ্চে উঠে ‘রাষ্ট্রপতি’কে সম্মান জানালেন। সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তিত্বদের ডামির পরে শিল্পজগৎ ও ক্রীড়াজগতের ‘প্রতিনিধিরা’ও দর্শকাসন থেকে উঠে গিয়েই ‘রাষ্ট্রপতি’র সঙ্গে পরিচিত হলেন।
মুখ্যসচিব সমর ঘোষ নিজে দর্শকাসনে থেকে সব দিকে লক্ষ রাখছিলেন। কিন্তু তাঁর ‘ডামি’ মঞ্চে বক্তৃতা দিতে এগিয়ে গেলেন মুখ্যসচিবের সামনেই। মুখ্যসচিব ছাড়াও স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশকর্তারা সারা ক্ষণ অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্যায় ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, সে-দিকে নজর রাখলেন। শুধু ‘রাষ্ট্রপতি’ থেকে শুরু করে সকলেরই বক্তৃতার অংশটুকু বাদ। এ ছাড়া গোটা অনুষ্ঠানটিই কার্যত হুবহু উপস্থাপিত হল। আর একটা ব্যাপার অবশ্য ছিল না মহড়ায়। রাষ্ট্রপতিকে সংবর্ধনার আসল অর্ঘ্যডালা। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানান, রাষ্ট্রপতিকে কাঁথাকাজের শাল-উত্তরীয় দেবে রাজ্য সরকার। আর থাকবে তাঁতের ধুতি-পাঞ্জাবি। |
মূল অনুষ্ঠানে যে-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, তার শিল্পীরাও এ দিন বার তিনেক তাঁদের উপস্থাপনা হুবহু পেশ করলেন। কলকাতার একটি গোষ্ঠীর ‘ক্রিয়েটিভ ডান্স’ বা সৃষ্টিশীল নাচ ছাড়াও নাচে-গানে এ রাজ্যের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ফুটিয়ে তোলা হবে রাষ্ট্রপতির সামনে। সেই অনুষ্ঠানের অবিকল মহড়া দেওয়া হল। দার্জিলিঙের লোকনৃত্য, জঙ্গলমহলের সাঁওতাল নাচ, ছৌ, রায়বেঁশে—পরিবেশিত হল সব কিছুই। কলকাতার একটি নৃত্যগোষ্ঠীর
পরিচালক বললেন, “সরকারি অনুষ্ঠানে আগেও যোগ দিয়েছি। কিন্তু মঞ্চে এ ভাবে খুঁটিয়ে মহড়া আগে হয়নি।” কলকাতা পুলিশের কর্তারা জানান, ইদানীং বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেরই মহড়া দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে তিন দিন ধরে অনুষ্ঠানের এতটা সবিস্তার মহড়ার অভিজ্ঞতা তাঁদেরও বড় একটা হয়নি।
আর কী বলছেন ডামিরা?
মমতার ভূমিকায় রীতিমতো অভ্যস্ত ছিপছিপে কনস্টেবল রিজওয়ানা। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ওই ভূমিকায় নামতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু দেশের রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় মঞ্চে হাজির হওয়াটা প্রবীণ দেওনারায়ণের পক্ষে নতুন অভিজ্ঞতা। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে পুলিশ কমিশনারের ডামি হয়েছিলেন তিনি। দেওনারায়ণ হেসে বললেন, “আসল অনুষ্ঠানে কোথায় ডিউটি পড়বে, জানি না। তবে ডামি হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানের নাচ-গান সবই দেখা হয়ে গেল।” |