প্রতিবাদে পথে নামলেও জোট ছাড়ছেন না মমতা
ভর্তুকিতে রাশ টেনে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
দাম বাড়ল ডিজেলের। স্মরণকালের মধ্যে সব চেয়ে বেশি। লিটারে পাঁচ টাকা। একই সঙ্গে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির উপরেও রাশ টানল কেন্দ্র। এখন থেকে পরিবার পিছু বছরে ছ’টি সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়া হবে। তার পর সিলিন্ডার কিনতে হবে বাজার দরে।
পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি হ্রাস, বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার দরজা বহুজাতিক সংস্থার জন্য খুলে দেওয়া আর বিমান পরিবহণে বিদেশি লগ্নির অনুমোদন— আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে এই তিনটিই বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে। কিন্তু শরিকি বাধার পাশাপাশি দলের একাংশেরও আপত্তির জেরে এর কোনওটা নিয়েই এগোতে পারছিল না কংগ্রেস। মন্ত্রিসভার বৈঠকে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল মনমোহন সিংহকে। এখন সেই আপত্তিতে শরিক হয়েছে সরকারের সহযোগী দল সমাজবাদী পার্টিও। বিমান পরিবহণে বিদেশি লগ্নি নিয়েও তৃণমূলের প্রাথমিক আপত্তি রয়েছে।
ফলে সব মিলিয়ে থমকে গিয়েছিল আর্থিক সংস্কার। মন্দার আবহে সরকারের স্থবিরতাকে দুষছিল শিল্প মহল। নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে মনমোহনকে কাঠগড়ায় তুলছিলেন অর্থনীতিবিদেরা।
এই অবস্থায় বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকে পেট্রোপণ্যে ভর্তুকির বোঝা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সিদ্ধান্তটা মোটের উপর প্রত্যাশিত ছিল বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবারীরা। কারণ, বেশ কিছু দিন ধরেই এমন সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছিল। দিন দু’য়েক আগে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতি কমিটির বৈঠকও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈঠক বাতিল করে আলোচনায় বসে কংগ্রেসের কোর গ্রুপ। যেখানে ডেকে পাঠানো হয় তেলমন্ত্রী জয়পাল রেড্ডিকে। দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটির সেই বৈঠকেই তেলে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত হয় বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর।
ছাঁটাই ভর্তুকি
কলকাতায় ডিজেল
বাড়ল ৫.৯৫* টাকা
হল ৫০.৭১ টাকা
ছিল ৪৪.৭৬ টাকা
* কর-সহ
রান্নার গ্যাস
পরিবার-পিছু ৩৯৯ টাকার ছ’টি সিলিন্ডার
মিলবে বছরে। তার পর কিনতে হবে বাজার
দরে। যা আপাতত ৭৫০ টাকার কাছাকাছি।
কম আদায়ের অঙ্ক
(আন্ডার রিকভারি)
• দৈনিক ৫৫০ কোটি টাকা
• দাম বাড়ার পরেও চলতি বছরে
• কম আদায় হবে ১ লক্ষ ৩ হাজার কোটি টাকা
সরকারের সিদ্ধান্তে শরিকরা ফুঁসে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু সমর্থন তুলে নিয়ে সরকার ফেলে দেওয়ার ইচ্ছা যে তাদের নেই, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছে একই সঙ্গে। আজ, শুক্রবার থেকে রাজ্যের প্রতিটি ব্লকে তৃণমূল কর্মীদের প্রতিবাদ আন্দোলন করার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। কলকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে গাঁধী মূর্তি পর্যন্ত তিনি নিজে মিছিল করবেন শনিবার। সরকারের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়েছেন। ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সাধারণ মানুষ ও চাষিদের কাঁধে ইতিমধ্যেই বিপুল বোঝা। সরকারকে বুঝতে হবে যে, এই সিদ্ধান্তে তাঁদের দুর্দশা আরও বাড়বে।’ কিন্তু তাই বলে ইউপিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন না মমতা। তাঁর মন্তব্য, “এক বার আমরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম। মানুষ তখন আমাদের ভুল বুঝেছিলেন। আমরা কেন্দ্রে স্থায়িত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তাই এখনই সমর্থন প্রত্যাহারের প্রশ্ন নেই।”
তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, এখনই লোকসভা নির্বাচন হলে তারা সবচেয়ে খুশি হবে। কিন্তু তৃণমূল সমর্থন তুলে নিলেই যে সরকার পড়ে যাবে এমন নয়। সেটা যদি না হয়, তা হলে সরকার থেকে সরে এসে আম-ছালা দুই-ই হারানোর যুক্তি কোথায়!
শরিকদের এই বাধ্যবাধকতার কথা কংগ্রেসও জানে। সেই কারণেই কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকিটা তারা নিতে পেরেছে। পাশাপাশি দলের একটা অংশের মতে, তেতো দাওয়াই দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। এমনিতেই দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে সরকার কোণঠাসা। ফলে খারাপ সময়ে খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া ভাল। তাতে জনগণের বিরূপতার মাত্রাটা খুব বেশি বাড়বে না। অন্য দিকে ভর্তুকি কমিয়ে যদি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যায়, কর্মসংস্থান করা যায়, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অর্থের সংস্থান করা যায়, তা হলে দেড় বছর পরে লোকসভা নির্বাচনের সময় সরকারের বুক বাজিয়ে কিছু বলার থাকবে।
রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির এই অঙ্ক কষেই তেলে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কংগ্রেসের কোর গ্রুপ। তবে তেল মন্ত্রক যতটা ভর্তুকি কমাতে চেয়েছিল, ততটায় সায় দেননি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। তেলমন্ত্রী জয়পাল রেড্ডির দাবি ছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি প্রতিদিন ৫৫০ কোটি টাকা কম আয় (আন্ডার রিকভারি) করছে। ফলে ডিজেলের দাম এখনই লিটার পিছু ১৭ টাকা বাড়ানো উচিত। সনিয়া সাফ বলে দেন, সেটা সম্ভব নয়। অর্থ মন্ত্রককে নতুন করে হিসেব করতে বলা হয়। যার পরিণতি লিটার-পিছু পাঁচ টাকা মূল্যবৃদ্ধি।
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজন গত এপ্রিলেই মনমোহনকে চিঠি লিখে বলেছিলেন ডিজেলের দাম লিটারে অন্তত চার টাকা এবং রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি বছরে ৬ থেকে ৭টি সিলিন্ডারে বেঁধে দেওয়া উচিত। তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কারণে চুপ করে থাকলেও এখন মোটামুটি ভাবে সেই সুপারিশই মেনেছে সরকার। সন্তুষ্ট রঙ্গরাজন এ দিন বলেছেন, “এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ আর্থিক ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। আর ডিজেলের দাম বাড়ায় ভারতের প্রতি ঋণদানকারী সংস্থাগুলির আস্থা বাড়বে।”
কংগ্রেসের কর্তাব্যক্তিরা চেয়েছিলেন, রান্নার গ্যাসে বছরে ৮টি সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়া হোক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তথা অর্থ মন্ত্রকের যুক্তি হল, যাদের জন্য এই ভর্তুকি, সেই গরিব মানুষদের বছরে ছ’টার বেশি সিলিন্ডার লাগে না। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের গায়ে তেমন আঁচ পড়বে না, এমনই দাবি সরকারি সূত্রের।
এই যুক্তি অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই মানতে নারাজ কংগ্রেস ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলি। মমতা যেমন বলেছেন, এ বারও তাঁদের অন্ধকারে রেখে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তেমনই সিপিএম সাধারণ সম্পাদক বিমান বসুর মন্তব্য, “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!”
বিক্ষোভে সামিল হয়েছে পরিবহণ সংগঠন, এমনকী পেট্রোলিয়াম ডিলাররাও। এ রাজ্যে বাস-ট্যাক্সির ভাড়া বাড়ানোর দাবি অনেক দিন ধরেই রয়েছে। ডিজেলের দাম বাড়ার পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভাড়া না বাড়ালে বাস চালানো বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে মালিকদের সংগঠন। একই দাবি মিনিবাস ও ট্যাক্সি মালিকদের। ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে এত দিন অনড় থাকা মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী করেন সেটাই এখন দেখার।
এটাও দেখার যে, তেলের দাম নিয়ে ‘সাহসী’ পদক্ষেপের পরে আর্থিক সংস্কারের অন্য দুই আশু অ্যাজেন্ডা নিয়ে কত দূর যায় কেন্দ্রীয় সরকার। শুক্রবার মন্ত্রিসভার অর্থনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকে বিমান পরিবহণে ৪৯ শতাংশ বিদেশি লগ্নির প্রস্তাব পেশ হওয়ার কথা। এ ব্যাপারে মমতার সম্মতি আদায় করতে কলকাতা গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বিমানমন্ত্রী অজিত সিংহ। কংগ্রেস সূত্রের মতে, যে হেতু তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে এই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলা নেই, সে হেতু মমতা শেষ পর্যন্ত বিষয়টি মেনে নিতে পারেন। তবে এ দিন যেমন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুপস্থিত থেকে তেলে ভর্তুকি তোলার সিদ্ধান্ত থেকে ‘দূরত্ব’ বজায় রেখেছেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়, শুক্রবারও তিনি একই কৌশল নিতে পারেন।
বিমান ক্ষেত্রের বাধা পেরোতে পারলে খুচরো ব্যবসা নিয়েও সরকার এগোতে চাইবে বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। পাশাপাশি শুক্রবারের বৈঠকে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ সংক্রান্ত প্রস্তাবও পেশ হওয়ার কথা।
দিনের শেষে সরকারের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সরকার ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। পারা না-পারার উপরে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, কংগ্রেসেরও।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.